মতপ্রকাশে মামলার ভয়

প্রতিকী ছবি

করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় দেশজুড়ে চলমান ‘সর্বাত্মক লকডাউনের’ মধ্যেই খুলনার সাংবাদিক আবু তৈয়বকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ফেসবুকে নিজের স্বাধীন মত তুলে ধরার কারণে। তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, সাংবাদিক তৈয়ব ফেসবুকে ‘মিথ্যা তথ্য’ দিয়ে ‘অপপ্রচার’ চালিয়েছেন।

গত ২০ এপ্রিল গ্রেপ্তার হওয়া আবু তৈয়ব জামিন চেয়েও পাননি, এখনো কারাগারে।

তিনি এনটিভির খুলনা ব্যুরো প্রধান। মুনস্টার পলিমার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তিনি। এ কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক মামলাটি করেছেন বলে জানান খুলনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হাসান আহমদ মোল্লাহ। তিনি বলেন, তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ফেসবুকে লিখেছিলেন অবু তৈয়ব। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, এর কোনো ভিত্তিই নেই। মেয়র এখানে কেবল তাঁর ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল-১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত বছরই সারা দেশে লেখক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে অন্তত ৪১টি। এসব মামলায় ৭৫ জন লেখক ও সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩২ জন। আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসে পাঁচটি মামলায় সাতজন সাংবাদিককে ডিজিটাল আইনের মামলায় আসামি করা হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আরএসএফ বলেছে, সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। মহামারি ও সমাজে তার প্রভাব নিয়ে প্রতিবেদন করার কারণে অনেক সাংবাদিক, ব্লগার, কার্টুনিস্ট গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে সরকারের কাছে এখন একটি অস্ত্র আছে, তা হলো ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।

ডিজিটাল আইনে করা একটি মামলায় কারাবন্দী অবস্থায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি লেখক মুশতাক আহমদের মৃত্যুর পর এই আইন যে মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা, সে বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘জনগণের কল্যাণে তথ্য’।

ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে করা অপরাধ দমন, প্রতিরোধ ও বিচারের জন্য ২০০৬ সালে দেশে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন হয়। ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করে ৫৭ নম্বর ধারা যুক্ত করা হয়। এই ধারায় মানহানি, কটূক্তি, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট করাসহ একগুচ্ছ অভিযোগে মামলার সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রবল সমালোচনার মুখে এ আইন বাতিল হয়ে ২০১৮ সালের অক্টোবরে আসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। নতুন আইনে দেখা যায়, কয়েকটি ধারায় পুরোনো ৫৭ ধারার নির্যাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে তথ্য ও মতপ্রকাশে আরও কিছু কড়া ধারা যুক্ত করা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে, এই আশঙ্কার কথা শুরু থেকেই বলে আসছে সম্পাদক পরিষদ। সম্পাদকদের এই সংগঠন বলেছে, এই আইনের নয়টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আইনটি সংশোধনের দাবিতে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর মানববন্ধন করেছিল সম্পাদক পরিষদ।

প্যারিসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) তাদের ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান (ভালো থেকে খারাপের দিকে) ১৫২। ২০০৯ সালে এই অবস্থান ছিল ১২১। অর্থাৎ এক যুগে বাংলাদেশ ৩১ ধাপ পিছিয়েছে।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আরএসএফ বলেছে, সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। মহামারি ও সমাজে তার প্রভাব নিয়ে প্রতিবেদন করার কারণে অনেক সাংবাদিক, ব্লগার, কার্টুনিস্ট গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন।

সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে সরকারের কাছে এখন একটি অস্ত্র আছে, তা হলো ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনে ‘নেতিবাচক প্রচারণা’র দায়ে সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছরের কারাদণ্ড। ফলে আত্মনিয়ন্ত্রণ (সেলফ-সেন্সর) অভূত পর্যায়ে পৌঁছেছে।

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ মনে করেন, বাংলাদেশে গণমাধ্যম যে স্বাধীনতা ভোগ করে, সেটি বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় অনেক ভালো। অনেক উন্নত দেশেও বাংলাদেশের মতো অবাধ স্বাধীনতা নেই। বিশ্ব সূচকে এক যুগে ৩১ ধাপ পিছিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যারা এই সূচক তৈরি করে, তারা মূলত এনজিও। তাদের এই সূচক তৈরি করতে কেউ বলেনি। তারা যে তথ্য দিচ্ছে, এর সঙ্গে তিনি একমত নন।

তবে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ মনে করেন, বাংলাদেশে গণমাধ্যম যে স্বাধীনতা ভোগ করে, সেটি বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় অনেক ভালো। অনেক উন্নত দেশেও বাংলাদেশের মতো অবাধ স্বাধীনতা নেই। বিশ্ব সূচকে এক যুগে ৩১ ধাপ পিছিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যারা এই সূচক তৈরি করে, তারা মূলত এনজিও। তাদের এই সূচক তৈরি করতে কেউ বলেনি। তারা যে তথ্য দিচ্ছে, এর সঙ্গে তিনি একমত নন।

অবশ্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যাতে অপব্যবহার না হয়ে, সে জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও তৎপর রয়েছে বলে জানান তথ্যমন্ত্রী।

মামলা করছেন ক্ষমতাবানেরা


লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকসহ চারজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গত বছরের ৩১ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। রায়পুর পৌরসভার মেয়র ইসমাইল খোকন বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

আর দুই মাস নিখোঁজ ও ছয় মাস কারাগারে থাকার পর গত ২৫ ডিসেম্বর জামিনে মুক্ত হওয়া ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন সাংসদ সাইফুজ্জামান।

গত বছর এবং চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যে ৪৬টি মামলা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করেছে প্রথম আলো। এই ৪৬ মামলার মধ্যে ১৩টি মামলার বাদী আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা করেছেন পাঁচটি মামলা। তিনটি মামলা করেছেন তিনজন সাংসদ। উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মতো জনপ্রতিনিধিরা করেছেন চারটি মামলা। সরকারি কর্মকর্তারা মামলা করেছেন দুটি, এর মধ্যে একটি মামলার বাদী একজন জেলা প্রশাসক, অন্যটির একজন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। সাংবাদিকেরা বাদী হয়েছেন তিনটি মামলার। বাকি মামলার বাদীর মধ্যে শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাস্থ্য কর্মকর্তার স্ত্রী, আইনজীবী, ধর্মীয় নেতা, শ্রমিকনেতা এবং রেস্তোরাঁ মালিক রয়েছেন।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল নিয়ে খবর প্রকাশ করায় ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হন অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনের খুলনা জেলা প্রতিনিধি হেদায়েত হোসেন মোল্লা। ওই মামলায় মানবজমিন-এর খুলনা প্রতিনিধি রাশেদুল ইসলামকেও আসামি করা হয়। ভোটের ফলাফলে ‘গরমিল’ হয়েছে, এমন খবর প্রচার করায় তাঁদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি করেন তৎকালীন বটিয়াঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেবাশীষ চৌধুরী।

হেদায়েত হোসেন মোল্লাকে অব্যাহতি দিয়ে গত মাসে এই মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। হেদায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ভোটের ফল ঘোষণার সময় তৎকালীন জেলা প্রশাসক খুলনা-১ আসনের ফল দুবার ঘোষণা করেছিলেন। সেখানে গণনায় প্রায় ২৩ হাজার ভোটের ব্যবধান ছিল। এ নিয়ে প্রতিবেদন করাতেই তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, বাধা দুই দিক থেকে আসে, একটি রাষ্ট্রীয়, অন্যটি রাষ্ট্রের বাইরের ক্ষমতাবান গোষ্ঠী। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে সহনীয় করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেটি এখন পর্যন্ত হয়নি।

অভিযোগের ধরন

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনের সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর বক্তব্য বিকৃত করে অনলাইনে সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি তিনজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

সরকারের দেওয়া ত্রাণের চাল চুরির বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় গত বছরের ১৭ এপ্রিল চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী থানায় মামলা করেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোমিনুল ইসলাম। এ মামলায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য দিয়ে সংবাদ পরিবেশন ও ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়।

যদিও পরবর্তী সময়ে চাল চুরির অভিযোগে এক জনপ্রতিনিধিকে (ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য) বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

সুনামগঞ্জ-১ আসনের (তাহিরপুর, ধরমপাশা, জামালগঞ্জ) সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হন সাংবাদিক মাহতাব উদ্দিন তালুকদার। ওই পোস্টে সাংসদের মানহানি হয়েছে, এমন অভিযোগ আনা হয়। গত বছরের ১৯ মে মাহতাবকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা বিভিন্ন মামলার অভিযোগের ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ত্রাণ চুরি, করোনার চিকিৎসার সমালোচনা, স্থানীয় সাংসদের সমালোচনা, নদী দখল, বাড়ি দখলে রাখার অভিযোগ—এসব বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জেরে ১৮টি মামলা হয়েছে। চলমান বিষয় এবং সরকার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় ২৬টি মামলা হয়েছে।

তিনটি মামলা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভে কথা বলায়।

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, মামলা করে একটি ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ধরনের পরিবেশ কর্তৃত্বশীল শাসনের ইঙ্গিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ, মুক্তবুদ্ধির চর্চার বাংলাদেশ গড়তে হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে।