মজার ছলে ‘বাংলার মিস্টার বিন’ করতে চান ভালো কাজ
যখন জাদু দেখান তখন তিনি জাদুশিল্পী রাসেদ শিকদার। আর অন্য সময় বাংলার মিস্টার বিন। হাস্যরসাত্মক ব্রিটিশ টিভি ধারাবাহিক মিস্টার বিনের চরিত্র আয়ত্তে আনতে রীতিমতো গবেষণা করতে হয় তাঁকে। মিস্টার বিনের মতো হতে পরতে হয় স্যুট-টাই। ঘুরতে হয় হাতে একটি পুতুল নিয়ে।
জাদুশিল্পী রাসেদ শিকদার পথেঘাটে হাঁটতে গেলে আশপাশের দু-একজন তাঁকে দেখে চমকে যান না তেমন হয় না। কেউ কেউ সেলফি তুলতে চান। তবে মানুষ সেলফি তোলেন জাদুশিল্পী নয়, বাংলার মিস্টার বিনের সঙ্গে। এই পরিচিতি এনে দিয়েছে রাসেদ শিকদারের চেহারা। শুরুতে এ চরিত্র আয়ত্তে আনতে মুখ, কপাল বাঁকাতে গিয়ে অবস্থা কাহিল হয়ে যেত তাঁর।
রাসেদ শিকদারের চুল, চাহনি থেকে শুরু করে পুরো অবয়বটাই যেন মিলে গেছে মিস্টার বিন চরিত্রে অভিনয় করা রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসনের সঙ্গে। ছোট বেলা থেকেই অনেকে চেহারার এ মিলের কথা বলতেন। তবে ২০১৫ সাল থেকে রাসেদ শিকদার অনেকটা সচেতন ভাবেই মিস্টার বিনকে অনুসরণের চেষ্টা করছেন। তবে তাঁর দুঃখ একটাই, বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও এখন পর্যন্ত আসল মিস্টার বিনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।
গত সোমবার দুপুরে রাসেদ শিকদার এসেছিলেন প্রথম আলো কার্যালয়ে। আলাপে বললেন, ‘আসলে কেউ হুবহু অন্যকে অনুকরণ করতে পারে না। মিস্টার বিনের সঙ্গে কোনোভাবে আমার চেহারার মিল আছে। আমি মিস্টার বিনের অভিনয় দেখি। অঙ্গভঙ্গিগুলো রপ্ত করার চেষ্টা করি। মিস্টার বিন চরিত্রটি জনপ্রিয়। আমি এ চরিত্রের মতো অভিনয় করে মানুষকে কিছুটা আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করি। আর এ মজার ছলেই কিছু ভালো কাজ করতে চাই। মানুষকে সচেতন করতে চাই। অনেকেই ডাস্টবিনে ময়লা না ফেলে অন্য জায়গায় ফেলেন। অথচ চেষ্টা করলেই কাজটি করা যায়।’
রাসেদ শিকদারের মিস্টার বিন বিডি নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল আছে। এর বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে বাংলার মিস্টার বিন হিসেবে অভিনয় করছেন। রাসেদ শিকদার বললেন,‘মিস্টার বিন চরিত্রটি একটি কমেডি চরিত্র। আমার মূল উদ্দেশ্য কমেডির মাধ্যমে মানুষকে সুস্থ বিনোদন দেওয়া। আর যে কাজই করি তাতে যাতে কিছু না কিছু শিক্ষণীয় বিষয় থাকে তার চেষ্টা করি। ফেসবুক–ইউটিউবের জন্য আমার খানিকটা পরিচিতি এসেছে। আর অনেকেই আমার ফেইস নিয়ে ভিউ কামাতে চান। অভিনয় করার জন্য প্রস্তাব দেন। তবে আসলেই ভালো কাজের সুযোগ আছে সে ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে চাই।’
পরিচিতি পাওয়ার পর থেকে রাসেদ শিকদার যে কোনো জাদু পরিবেশনের আগে মঞ্চে কিছুক্ষণ মিস্টার বিনের মতো পোশাক পরে হাতে পুতুল নিয়ে অভিনয় করেন। পরে জাদুর নির্দিষ্ট পোশাক পরে জাদুশিল্পী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসনের মিস্টার বিন শো প্রচারিত হয় ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। সিরিজটি সারা বিশ্বের ২৪৫টি স্থানে বিক্রি করা হয়েছে। পাশাপাশি সিরিজটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অ্যানিমেশন সিরিজও বানানো হয়েছে। বানানো হয়েছে দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। বাংলাদেশেও মিস্টার বিন ছোট এমনকি বড়দের কাছেও প্রায় সমান জনপ্রিয়। টুকটাক কথা বলে আর অঙ্গভঙ্গি করেই জনপ্রিয় হয়েছেন অভিনেতা রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসন।
পাবনার ছেলে রাসেদ শিকদার হাসতে হাসতে বললেন, রাস্তাঘাটে শিশুরা যখন তাঁকে দেখে তখন তারা ভাবে তিনি সত্যিই মিস্টার বিন। টেলিভিশনের ভেতরে ঢুকে কীভাবে তিনি কার্টুন হয়ে যান তারপরেই থাকে এ প্রশ্ন।
পড়াশোনা শেষ হয়নি রাসেদ শিকদারের। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। কাজের সূত্রে বেশির ভাগ সময় থাকতে হয় ঢাকায়। ছোট বেলায় একজন জাদুশিল্পী রাসেদের স্কুলে এসেছিলেন। মাটিকে জাদু করে চকলেট বানিয়ে ফেলেছিলেন। সেই চকলেট রাসেদ খেয়েছিলেন। যখন-তখন চকলেট খাওয়ার লোভে ছোট বেলা থেকেই জাদুশিল্পী হতে চাইতেন রাসেদ। প্রিন্স আকাশের হাত ধরে ২০১০ সালে জাদু শেখার হাতেখড়ি হয় তাঁর। তিনি বাংলাদেশের ম্যাজিক ফেডারেশন এবং ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিশিয়ানস এর সদস্য। ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) জাদু বিষয়ক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘চোখের পলকে’ নিয়মিতভাবে জাদু দেখান।
জাদু নিয়ে রাসেদ শিকদারের বক্তব্য হলো এটি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক শিল্প। এতে সত্য বা মিথ্যা বলতে কিছু নেই। তবে দেশে এখনো জাদুকে পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো সময় আসেনি। অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার ইচ্ছে আছে। তা না হলে সবার আগে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। জাদু আর অভিনয় শখ হিসেবেই থেকে যাবে।
রাশেদ শিকদারের জন্ম ১৯৯৮ সালে। তাঁরা চার ভাই, এক বোন। বাবা মো. আবদুল মান্নান শিকদার ব্যবসায়ী। মা আসমা বেগম গৃহিণী। বাইরের মানুষের মতো পরিবারের সদস্যরাও আসল মিস্টার বিনের ভক্ত। রাসেদের কাজেও অনুপ্রেরণা দেন পরিবারের সদস্যরা।
রাসেদ শিকদার বলেন, আসল মিস্টার বিন অর্থাৎ রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসনকে তিনি শ্রদ্ধা করেন। তবে মিস্টার বিন হিসেবে তিনি যেসব অভিনয় করেছেন তার সবই ভালো লেগেছে তেমন নয়। তাই বলা যায় পুরোপুরি আসল মিস্টার বিনকে নকল করা বা অনুসরণ করা বলতে যা বোঝায় রাসেদ তা করতে চান না। মিস্টার বিনের অঙ্গভঙ্গি ঠিক রেখে ভিন্ন গল্প নিয়ে কাজ করছেন রাসেদ। মিস্টার বিনের হাতে সব সময় যে পুতুল বা টেডি বিয়ার থাকে একই রকম পুতুল পেতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। অবশেষে একটি অনলাইন থেকে গত বছর মে মাসে একদম হুবহু না হলেও কাছাকাছি একটি পুতুল কিনতে পেরেছেন রাসেদ।
এম রহমান নামের একজন জাদুশিল্পী প্রথম রাসেদ শিকদারকে বাংলার মিস্টার বিন নামটি দিয়েছিলেন। হাসতে হাসতে রাসেদ বলেন, নতুন মানুষের কাছে তিনি রাসেদ শিকদার নামেই পরিচিত হতে যান। ওই মানুষটি যখন জানতে চান আপনিই তাহলে বাংলার মিস্টার বিন তখন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেন।
আসল মিস্টার বিন চরিত্রের সংলাপ বলতে গেলে খুবই কম। এটা একদিক থেকে নিজের জন্য ভালোই হয়েছে বলে উল্লেখ করলেন রাসেদ। তিনি বলেন, চেহারা মিলে যাওয়াটাকে তিনি সৌভাগ্যই মনে করেন। এতে করে অনেকেই তাঁর কাজ, জাদু সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হচ্ছে যা মিস্টার বিনের সঙ্গে চেহারায় মিল না থাকলে সম্ভব হতো না। রাসেদ হাসতে হাসতে এ–ও বললেন,‘ খারাপ কাজ করা কোনো মানুষের সঙ্গে চেহারা মিলে গেলে অবশ্যই তাকে অনুসরণের চেষ্টা করতাম না।’