ভয়হীন আলিঙ্গনের দিন আসবে আবার

২০২১ সাল হয়ে উঠতে পারে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত বছর। প্রিয়জন আর পুরোনো জীবনধারা হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে মানুষ আবার সভ্যতার চাকা ঘোরাতে নামবে।

অ্যাম্বুলেন্সে অপেক্ষারত রোমানাকে অভয় দিচ্ছেন তাঁর স্বামী, ১৫ জুন ২০২০
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

বিশ্ব ইতিহাসের একটা কুখ্যাত বছর বিদায় নিল। সন্দেহ নেই এ বছরের প্রধান চরিত্র ছিল মহামারি। এ পর্যন্ত সাড়ে ১৭ লাখ মানুষ কেড়ে নিয়েছে করোনাভাইরাস। বাংলাদেশেও মৃত্যু সাড়ে সাত হাজার ছাড়াল। হারিয়ে যাওয়ার ভয় এখনো তাড়া করছে বিশ্ববাসীকে। কিন্তু বেশ দ্রুত, ৩৬৫ দিনের চেয়ে কম সময়েই বছরটি পার হলো কি?

ভালোই হয়েছে! অন্য রকম একটা বিশ্বের দিকে মানুষের যাত্রা দ্রুত হওয়া দরকার।

মানুষের বোঝাপড়াকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে ভাইরাস।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরের ৭৫ বছর মানুষ কেবল ছুটেছে। ছোটার উন্মাদনা তৈরি করা হয়েছিল। তুমুল গতির সেই ট্রেনের লাগাম টেনে ধরেছে মারি। এতে ঝুঁকির জায়গাগুলো দেখতে পেলাম সবাই।

মানুষ ডেকে আনেনি এ সংকট। ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার ফসল এটা। মহামারি দেখাল বিশ্বব্যবস্থায় অনেক নাজুক জায়গা ছিল। জাতিবাদ, দুঃশাসন আর অর্থনৈতিক লোভ ভুল হিস্টিরিয়ায় ভুগিয়েছে। মেধা ও শ্রম সঠিক জায়গায় জড়ো করা যায়নি। এসব বোঝাপড়ায় মানুষকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে ভাইরাস-তরঙ্গ।

বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা পেয়েছিল এবং সেটা টেকসই হয়েছে। ওই যুদ্ধের পরই অনেক দেশ জনস্বাস্থ্যব্যবস্থায় মনোযোগ দেয়। সেটা দরকারি প্রমাণিত হয়েছে। করোনা এসব জনমুখী পদক্ষেপ আরও এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ তৈরি করেছে। ইতিমধ্যে তার ছাপও পড়ছে দেশে দেশে নেতাদের ওপর।

লকডাউন মানুষকে বাঁচাতে মোটেই যথেষ্ট নয়। সেটা জেনেছি আমরা। দরকার স্বাস্থ্য খাতে ও জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন। এ অভিজ্ঞতা নিয়ে নতুন বছরে পা ফেলছি আমরা।

বিপুল সংস্কারের দিকে এগোবে বিশ্ব

বিপুল সম্পদের ওপর দাঁড়িয়ে বিশ্ব। কিন্তু ধনীদেরও শরীরী নিরাপত্তা দিতে পারল না ধন। এটাও মহামারির বড় শিক্ষা। বাংলাদেশেও বহু ধনাঢ্যজনকে ভাইরাসের কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। ধনী জীবিতরাও স্বস্তিতে নেই। একই অবস্থা অন্যান্য দেশেও। ‘সিস্টেম’-এর অসহায়ত্ব ধরা পড়ল এভাবেই।

এর পরোক্ষ বার্তা বিশ্বজুড়ে ফাঁক-ফোকরহীন এক স্বাস্থ্যব্যবস্থা লাগবে আমাদের। মহাশূন্যে একের পর অভিযানের চেয়েও যা দরকারি। মানুষের হাতে যে সম্পদ আছে, তাতে সে রকম স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়া কোনো সমস্যাই নয়। এই অগ্রাধিকারের দিকে যাত্রা এখন অবশ্যম্ভাবী। আন্তর্জাতিক পরিসরে জাতিসংঘের চেয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যে বেশি মনোযোগ পাওয়া প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই পালাবদলের সবকিছু অস্থায়ী হবে না। ‘নতুন স্বাভাবিক’ হয়ে যাবে অনেক কিছু। আর্জেন্টিনার ফার্নান্দেজ সরকার অতিসম্প্রতি সমাজের সবচেয়ে ওপরের তলার ১% সামর্থ্যবানের ওপর সামান্য কর বাড়িয়েছে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের রসদ হিসেবে। এভাবে অনায়াসে তারা চার বিলিয়ন ডলার জোগাড় করছে মহামারি-পরবর্তী পুনর্গঠনের জন্য।

গণতান্ত্রিক সরকারগুলো নিজ নিজ দেশের স্বাস্থ্য খাত পুনর্গঠনে নেমে পড়ছে। এই প্রবণতা ভবিষ্যতে বাড়বে। বাড়তে বাধ্য। বিশ্বজুড়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় এ দশকে বড় পরিবর্তন অত্যাসন্ন। কোনো একক দেশের তাতে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। তাতে বিশ্বসমাজে সেই দেশ আত্মঘাতী বার্তা দেবে। বিনিয়োগ-পরিবেশের নতুন শর্ত এখন স্বাস্থ্য নিরাপত্তা। পাশাপাশি, করপোরেটদের নৈতিক-সামাজিক দায়ের প্রশ্নটিও অতীতের চেয়ে বেশি করে সামনে আসছে এবং আসবে।

অর্থনৈতিক জগতে পুরোনো ধাঁচে বাণিজ্য চলবে না আর। সৃজনশীল উদ্যোগের চাহিদা তৈরি হয়েছে। প্রচলিত ব্যাংক-বিমা-করপোরেটদের বিপুল সাংগঠনিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে এই মুহূর্তে। ২০২১ এটাকে বেগবান করবে।

ঘরে বসে কাজের ধারণা অর্থনীতির জগতের সাংগঠনিক চিন্তায় কর্তৃত্ববাদী সংস্কৃতির অবসান ঘটাচ্ছে ক্রমে। পরিবর্তনের অভিমুখে নারীর হিস্যাও বাড়তে চলছে। সঙ্গে আসছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন সর্বগ্রাসী যুগ। এটা অটোমেশনের দিকে নেবে আমাদের। বাংলাদেশের জন্য যা চ্যালেঞ্জিং ও উদ্বেগের। তবে ভালো খবর হলো, অর্থনীতির স্থানীয়করণে ভোক্তা-ক্রেতা-বিক্রেতার পক্ষপাত বেড়ে গেছে বহুগুণ। চারদিকে ‘লোকাল সাপ্লাই চেইন’ গড়ার হিড়িক পড়েছে। এই প্রবণতা প্রচুর প্রশিক্ষণ চাহিদা তৈরি করবে এবং উচ্চশিক্ষার পুরোনো ধাঁচের অবকাঠামোতে ছুটির ঘণ্টা বাজাচ্ছে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় এই ঘণ্টাধ্বনি আপাতত মৃদু। তীব্রতা বাড়বে সামনে। এ বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার পরই সেসব সংস্কারের দিকে যাবে বিশ্ব।

করোনার প্রাদুর্ভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিলেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবীরা। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা ২৩ এপ্রিল
ছবি: দীপু মালাকার

নতুন ‘সামাজিক চুক্তি’র উষালগ্ন ২০২১

কোভিড বিশ্বনেতাদের সামনেও কিছু দগদগে ঘা সারাইয়ের ডাক দিয়েছে। অসম বিশ্বায়ন ও মুনাফাবাদী বিশ্বব্যবস্থা সর্বগ্রাসী যে বৈষম্য তৈরি করেছে, তাতে বিশ্ব হুমকির শিকার ছিল। পদ্ধতিগত ঝামেলা ছিল বিশ্বব্যবস্থায়। বস্তুগত সম্পদ স্তূপ করা এবং সামরিকায়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এত দিন নেতৃত্ব।

এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে জলবায়ুতে। দ্বিতীয় প্রধান ক্ষতি গুটিকয় মানুষের হাতে বৈশ্বিক সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে যাওয়া। মহামারি এই দুই রোগ সারাইয়ের গুরুতর তাগিদ দিচ্ছে। ভালো লক্ষণ, ট্রাম্পবাদের কুৎসিত চারটি বছর পেছনে ফেলে আমেরিকা বৈশ্বিক জলবায়ু সুরক্ষার আলোচনায় ফিরতে চলছে। তবে প্রাণ-প্রকৃতির প্রশ্নটি কেবল আমেরিকার ডেমোক্র্যাটদের শুভ-ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিচ্ছে না দুনিয়া। কোভিড মানুষকে আবার প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীল করেছে।

‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ সম্পর্কে ভাইরাস মানুষকে বেশ কষ্ট দিয়েই হুঁশিয়ার করল। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এই উপলব্ধি এখন অনেক প্রবল মানুষের সুস্থতার স্বার্থে প্রকৃতির সুরক্ষা জরুরি। রোদ ও বাতাস ছাড়া চলবে না। প্রাকৃতিক সম্পদে খোঁড়াখুঁড়ি এবং ব্যবসায়ীদের হাতে সেগুলো ছেড়ে দেওয়ার আগে অনেক দেশেই নীতিনির্ধারকেরা দ্বিতীয়বার ভাবতে বসছেন এখন। বাংলাদেশও ইতিমধ্যে কয়লাভিত্তিক কর্মকাণ্ডে পুনর্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা ভালো ইঙ্গিত দেয়। এসবই নতুন এক ‘সামাজিক চুক্তি’র সূচনা। ২০২১ তার উষালগ্ন।

দুনিয়া ক্রমে উন্নয়নকাজে প্রকৃতির সঙ্গে সমঝোতা করে এগোতে চাইছে। কোভিড দেখাল এটাই টেকসই পথ। এ পথেই খাদ্যনিরাপত্তার নতুন ধারণা ও আকাঙ্ক্ষাও চলে এসেছে সমাজে। ‘অধিক খাদ্য ফলানো’র নামে আসা বিষভিত্তিক চাষাবাদ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুডের বিকল্প খুঁজছে মানুষ, যা প্রাকৃতিক কৃষি-সংস্কৃতির কদর বাড়াচ্ছে বহুগুণ। খাদ্য উৎপাদনে কমিউনিটির কর্তৃত্ব ও মতামতের দিকে আবারও মনোযোগ আসছে। আসন্ন বছর এই খাতে মোটা দাগে পরিবর্তন দেখব আমরা। মানুষ প্রজাতি তার অস্তিত্বের স্বার্থেই প্রকৃতিবিরোধী উন্নয়ন ধারণাকেও প্রতিরোধ করবে বলে আশা করার কারণ ঘটেছে।

নিরাপদ খাদ্য ও প্রকৃতি রক্ষা যে সামাজিক ন্যায়বিচারের জরুরি শর্ত, করোনা-পরবর্তী বিশ্ব সেটা আর অবজ্ঞা করতে পারছে না। কৃষিপ্রশ্ন রাজনীতিতে নতুন করে ফিরছে। ভারতের চলতি কৃষক ঘেরাও তার বড় ইশারা।

দেশে দেশে আর্থিক বৈষম্য কমানোর আওয়াজও জোরদার হচ্ছে। কৃষি ও বৈষম্য এই দুই অ্যাজেন্ডার ফয়সালা না করে আগামী বিশ্ব এগোতে পারবে না। এটাই বিশ্বনেতাদের জন্য মহামারির বড় শিক্ষা। চীনসহ কিছু দেশ প্রযুক্তি ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে মন্দা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর যে চেষ্টা করছে, তাতেও পদ্ধতিগত পুনর্ভাবনা জরুরি। একটা স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যতের জন্য স্বাধীন মুক্ত মানুষের গণতান্ত্রিক সমাজের বিকল্প নেই। চীনের চেয়ে তাইওয়ান মহামারি মোকাবিলায় যে অধিক সফল হলো, সেটা শেষোক্ত দেশটির অধিক গণতান্ত্রিক আবহ এবং রাজনৈতিক জবাবদিহির কারণেই। এ বার্তাগুলো অবহেলার নয় আগামীর জন্য। রেললাইন, ব্রিজ, সুউচ্চ ভবনের মুগ্ধতার পাশাপাশি আবারও মানুষকে শরীর ও মনের স্বাভাবিক স্বস্তি ফিরিয়ে দিতে হবে। ইট-সিমেন্টনির্ভর ‘উন্নয়ন’ ধারণার জরুরি প্রত্যাবর্তন দরকার সেদিকে।

শঙ্কার দিকও আছে। ফোন, ইন্টারনেটসহ যোগাযোগপ্রযুক্তিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করে কর্তৃত্ববাদী সমাজের নতুন কাঠামো গড়তে চাইছে অনেক শাসকগোষ্ঠী। কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সামনে ২০২১-এ এরাই বড় প্রতিপক্ষ।

আলিঙ্গনের দিন আসবে আবার

বহুকাল প্রজাতি হিসেবে মানুষ ছিল অদম্য। তার ইচ্ছাশক্তির সামনে কোনো প্রজাতি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কোভিড-১৯ কেবল তাই করেনি, মানুষের অস্তিত্বের জন্যই হুমকি হয়ে উঠেছিল। কিন্তু একাধিক ভ্যাকসিন আবিষ্কার এবং জীবনধারা বদলে মানুষ সেই বাধা অতিক্রমের পথে। সভ্যতা গড়ার পথে এত দিনের পুরোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভুল ও লোভাতুর অভ্যাসের খোলস ছেড়ে মানুষ নতুন এক বিশ্ব গড়ে তোলার দিকে এগোতে চলেছে এ বছর।

মানুষের ইতিহাস অতীতে আঞ্চলিক অনেক বিপ্লব দেখেছে। কিন্তু এই প্রথম মানুষ একসঙ্গে এক বৈশ্বিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দিচ্ছে ভাইরাসকে পরাজিত করতে গিয়ে। সমকালীন বিশ্ব এই প্রথম দেখছে মানবসমাজের ভবিষ্যৎ যৌথতায়। সবাই আমরা এক নৌকায় ছিলাম না, কিন্তু সবাই একই সমুদ্রে একই ঢেউয়ের শিকার। এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, কোনো দেশ বিশ্বকে এককভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা রাখে না। মানুষের তৈরি সীমান্তগুলো সংকটে সুরক্ষা দিতে পারেনি। বিচ্ছিন্নভাবে ভালো থাকার ধারণার পরাজয় ঘটিয়েছে কোভিড। বুঝিয়ে দিয়েছে একাকিত্ব কত বিরক্তিকর। বন্ধুত্ব ও সংহতি কত গুরুত্বপূর্ণ।

এই উপলব্ধির জোরেই আগামী বছরের নায়ক হতে পারেন মারি জয়ী মানুষ। তার সব লক্ষণ ইতিমধ্যে স্পষ্ট। সেই অর্থে ২০২১ সাল হয়ে উঠতে পারে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত বছর। প্রিয়জন আর পুরোনো জীবনধারা হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে মানুষ আবার সভ্যতার চাকা ঘোরাতে নামবে। কিন্তু নতুন মূল্যবোধ নিয়ে। করমর্দন তো বটেই, মানুষ আবার পরস্পরকে আলিঙ্গন করবে ভয়হীন চিত্তে। মুখোশ মানেই সামাজিক অস্তিত্বহীনতা! নিশ্চয়ই আমরা ‘মুখোশ’ খুলে ফেলতে পারব।


আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক