ভেড়াটি ছেড়ে যাবে গন্ডারকে
দৃশ্যটা দেখতে একটু খাপছাড়া লাগে। একটি বিশালদেহী গন্ডারের সঙ্গে ঘোরাফেরা করছে ছোট্ট আকৃতির ভেড়া। তাও দুটি এক খাঁচায়। গন্ডার যদি মাংসাশী প্রাণী হতো তাহলে না হয় ভেড়া রাখার মাজেজা থাকত। কিন্তু দুটোই তো তৃণভোজী। তাই খাঁচাটিকে ঘিরে অনেকেরই কৌতূহলী দৃষ্টি ঘুরছিল। কেউ কেউ বলছিলেন, ‘গন্ডারের সঙ্গে ভেড়া কেন?’
রাজধানী ঢাকার মিরপুরে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় গত সাত বছরে একাধিকবার যাঁরা গেছেন, তাঁরা হয়তো জানেন, প্রায় সাত বছর ধরে ভেড়াটি কাঞ্চি নামের নারী গন্ডারটির বিকল্প সঙ্গী। আড়াই বছর আগে এই দুই বান্ধবীকে নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়েছিল। পুরুষ সঙ্গী হারিয়ে মৃতপ্রায় কাঞ্চি বেঁচে যায় এই গাড়ল প্রজাতির নারী ভেড়াটির কারণেই। এখনো ওই একই ভেড়া গন্ডারটির সঙ্গী হিসেবে রয়েছে। কাঞ্চির জন্য এখনো কোনো পুরুষ গন্ডার আনা হয়নি। আর ভেড়াটিও বিচ্ছিন্ন রয়েছে ভেড়ার পাল থেকে।
তবে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছেন, এই জুনের মধ্যে নারী গন্ডারের জন্য সঙ্গী হিসেবে একটি পুরুষ গণ্ডার আনা হবে। তারপর ভেড়াটিকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে কাঞ্চির কাছ থেকে।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখা যায়, কাঞ্চি অলস সময় কাটাচ্ছে। সেটির কাছাকাছি বসে আছে ভেড়াটি। একপর্যায়ে কাঞ্চি উঠে দাঁড়ালে ভেড়াটিও সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে যায়।
রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে চিড়িয়াখানায় স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে ঘুরতে এসেছিলেন আবদুস শহীদ। তিনি বললেন, ‘বড় মেয়েটিকে নিয়ে আট-নয় বছর আগে একবার এসেছিলাম। এখন ছোট মেয়েকে পশু-পাখি দেখাতে নিয়ে এসেছি। তবে এবার গন্ডারের খাঁচার সামনে এসে খুব অবাক হলাম। গন্ডার আর ভেড়া একসঙ্গে থাকতে পারে জানতাম না।’
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মেনেস নামে এক ব্যক্তির ফার্ম থেকে আনা হয় দুটি গন্ডার। ২০১৩ সালে পুরুষ গন্ডারটি মারা গেলে কাঞ্চি একা হয়ে যায়। সঙ্গী হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া কাঞ্চিকে চিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। কিন্তু চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছিল না কাঞ্চি। এরপর গন্ডারের মালিক মেনেসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ঢাকায় আসার পর গন্ডারটিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, কাঞ্চি একাকিত্বে ভুগছে। ওষুধে কাজ হবে না। সঙ্গীর অভাবে অসুস্থ হয়ে কাঞ্চি মারা যেতে পারে। পরে তাঁর পরামর্শে কাঞ্চির জন্য পরীক্ষামূলকভাবে তৃণভোজী সঙ্গী গাড়ল ভেড়া দেওয়া হয়।
ঢাকা চিড়িয়াখানার কিউরেটর নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পুরুষ গন্ডারটি মারা যাওয়ার পর নারী গন্ডারটি একাকিত্বে ভোগা শুরু করে। অসুস্থ হয়ে যায়। এটি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। চোখ দিয়ে পানি পড়ত। গন্ডারটির আগের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি গন্ডারটির সঙ্গী হিসেবে নারী ভেড়া দেওয়ার পরামর্শ দেন। ভেড়াটিকে দেওয়ার পর সেটি খাওয়া-দাওয়া শুরু করে। সুস্থ হয়ে যায়। তখন থেকেই গন্ডারটির সঙ্গী হয়ে আছে ভেড়াটি।
তিনি জানান, একটি ভেড়া ১৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে। অন্যদিকে গন্ডার ৩০-৪০ বছর বেঁচে থাকতে পারে। কাঞ্চি নামের গন্ডারটির বয়স প্রায় ১১ বছর। আর গাড়ল ভেড়াটির বয়স প্রায় আট বছর। ভেড়াটির কোনো নাম দেওয়া হয়নি।
সাত বছরেও গন্ডারটির প্রকৃত সঙ্গী আনা হলো না কেন জানতে চাইলে কিউরেটর নুরুল ইসলাম বলেন, ‘দুই-তিন মাসের মধ্যে পুরুষ গন্ডারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করব আমরা। আশা করি, জুন মাসের মধ্যে নতুন একটি গন্ডার চলে আসবে।’
সঙ্গী গন্ডার চলে এলে ভেড়াটিকে সরিয়ে দেওয়া হবে কিনা প্রশ্ন করা হলে কিউরেটর বলেন, ‘সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। তবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে পরিস্থিতির ওপর। দুটি গন্ডারের সঙ্গে ভেড়াটিকে রাখা যাবে কিনা সেটা বুঝতে হবে আগে।’
কাঞ্চি নামে গন্ডারটির আচরণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম নিয়ামুল নাসের বলেন, এটা প্রাণিজগতের সহজাত আচরণ। মানুষের মতো প্রাণিজগতেও অনুভূতি, ভালোবাসা, আবেগ রয়েছে। অনেক প্রাণীর মধ্যে পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিকতা মেনে চলতেও দেখা যায়। কোনো গরুর বাছুর মরে গেলে গরু দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ওই সময় খড় দিয়ে বাছুর আকৃতি বানিয়ে বাছুরের চামড়াটি দিয়ে মুড়িয়ে গরুর সামনে রাখলে গরু নিজের বাছুরই মনে করে। এই প্রক্রিয়ায় অনেক সময় গরুটি আবার দুধ দেওয়া শুরু করে। অনেক প্রাণী সঙ্গীকে হারালে কষ্ট পায়, একাকিত্বে ভোগে, মারাও যায়।
এম নিয়ামুল নাসের বলেন, পশুদের এই আচরণের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তাদের স্বাভাবিক জীবনের যেন ছন্দপতন না হয়, সে স্থানটুকু তাদের দিতে হবে।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চিড়িয়াখানায় এখন ১৩৭ প্রজাতির দুই হাজার ৭৯০টি প্রাণী রয়েছে।
আরও পড়ুন:
অন্য রকম দু্ই বান্ধবীর গল্প