ভুয়া সনদে দুই ভাইয়ের চাকরি
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার দড়গ্রাম ইউনিয়নের তেবারিয়া গ্রামের কৃষক আবদুস সামাদ মুক্তিযোদ্ধা নন৷ তঁার দুই ছেলে মো. মইনুল ইসলাম ও মো. মনিরুজ্জামান ভুয়া সনদে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নিয়েছেন৷
মইনুল যশোরের বেনাপোল কাস্টমস হাউসে সহকারী কমিশনার পদে ও তাঁর ছোট ভাই মনিরুজ্জামান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনে শুল্ক, আবগারি ও ভ্যাট অনুবিভাগের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করছেন৷ তিনি ঢাকা পশ্চিমাঞ্চলে কর্মরত রয়েছেন৷ উভয়ই স্বীকার করেছেন তাঁদের বাবা মুক্তিযোদ্ধা নন৷
মইনুল জানিয়েছেন, প্রশাসন ক্যাডারের সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা তাঁর এক আত্মীয়কে চোরাকারবারিতে সহায়তা করার শর্তে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তাঁদের চাকরির ব্যবস্থা করেন৷ মইনুল ওই কর্মকর্তার পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি৷
মইনুলের চাকরি হয়েছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (৩১তম বিসিএস) মাধ্যমে৷ আর মনিরুজ্জামানের চাকরি হয়েছে কমিশনের সচিবালয়ের প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে৷ নিয়োগ সংক্রান্ত কাগজপত্রে দেখা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের আওতায় কর্মকমিশন সচিবালয় থেকে গত বছর ১৮ ডিসেম্বরে এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ৭৬২ জনকে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়৷ ওই নিয়োগ তালিকায় ছিলেন মনিররুজ্জামান (মেধাক্রম ৬৭৭, রেজিস্ট্রেশন নম্বর ০৪১২২৮)৷ নিয়োগ আদেশে তাঁর নামের পাশে উল্লেখ করা হয়েছে ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’৷ ১১ মে তিনি চাকরিতে যোগদান করেন৷
আর ৩১তম বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন মইনুল ইসলাম৷ তাঁর মেধাক্রম ৭৪ এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর ০২৭৮৭৬৷ নিয়োগ আদেশে তাঁর নামের পাশেও লেখা রয়েছে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’৷
পরীক্ষার সময় দেওয়া প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সঙ্গে মইনুল ইসলাম একটি মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র (সাময়িক) জমা দেন৷ সনদে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী ও সচিবের স্বাক্ষর রয়েছে৷
পরবর্তী সময়ে বিসিএস পরীক্ষার্থী হিসেবে মইনুল কর্ম কমিশন সচিবালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের (ক্যাডার) কাছে লিখিত এক আবেদনে উল্লেখ করেন, ‘আমার পিতা আব্দুল সামাদ একজন মুক্তিযোদ্ধা৷ তাঁর মুক্তিবার্তা নম্বর (চূড়ান্ত তালিকার লাল বই) ০১০৭০৫০১১৯৷ আমার এসএসসি ও এইচএসসি সনদে আমার পিতার নাম মোহাম্মদ আব্দুল সামাদের পরিবর্তে ভুলক্রমে আব্দুস সামাদ মুদ্রিত হয়৷ পরবর্তী সময়ে যা সংশোধন করা হয়েছে৷’ কিন্তু তাঁর সংশোধিত কোনো সনদ পাওয়া যায়নি৷
এদিকে মনিরুজ্জামান যে সার্টিফিকেট জমা দেন তাতে তাঁর বাবার নাম আব্দুস সামাদ উল্লেখ করা হয়েছে৷ প্রথম আলোর অনুসন্ধানে সাটুরিয়া উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় দড়গ্রাম ইউনিয়নের তেবারিয়া গ্রামে আব্দুস সামাদ বা আব্দুল সামাদ নামে কোনো মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যায়নি৷ তবে আব্দুস সামাদ নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন উপজেলার বরাইদ ইউনিয়নের ছনকা গ্রামে৷ তাঁরও মুক্তি বার্তা নম্বর ০১০৭০৫০১১৯৷ তাঁর বাবার নাম ইয়াছিন মণ্ডল৷
দড়গ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আলী নূর বকসসহ স্থানীয় আরও কয়েকজন লোক জানান, আব্দুস সামাদ একজন কৃষক৷ তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি৷ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক দপ্তর কমান্ডার মোতালেব হোসেন বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় দড়গ্রাম ইউনিয়নের তেবারিয়া গ্রামে আব্দুস সামাদ নামের কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই৷
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মনিররুজ্জামান বলেন, ‘আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না৷ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আমরা চাকরি নিইনি৷ কম্পিউটারে ভুলক্রমে নিয়োগ কতৃর্পক্ষ আমাদের নামের পাশে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা লিখেছেন৷ এ জন্য নিয়োগ কতৃর্পক্ষই জবাব দেবেন৷’
মইনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি প্রথমে সাধারণ কোটায় চাকরির জন্যই আবেদন করেছিলাম৷ কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা তাঁর আত্নীয়কে ভারত থেকে অবৈধ মালামাল পাচারে সহায়তা করার শর্তে বেনাপোল কাস্টমস হাউসের সহকারী কমিশনার পদে আমাকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন৷ আমার বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদও ওই কর্মকর্তাই তৈির করে দেন৷’ তবে মইনুল ওই কর্মকর্তার পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি৷
যোগদানের পর ওই কর্মকর্তার আত্মীয়কে চোরাকারবারিতে সহায়তা করেছেন কিনা জানতে চাইলে মইনুল ইসলাম বলেন, ওই কর্মকর্তার আত্মীয় লাগেজে করে কিছু মালামাল পাচার করছেন৷ আর এ কাজে তাকে তিনি সহায়তা করেছেন৷ ওই ব্যক্তি বড় ধরনের কোনো মালামাল পাচার করছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই ব্যক্তি এখনও ‘সেনসেটিভ’ কোনো মালামাল পাচার করেননি৷