ধর্ষণের মামলা
ভুক্তভোগীদের ৪৫% শিশু–কিশোরী
রাজধানীতে গত ১০ মাসে যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তাদের বড় অংশই নিম্ন আয়ের পরিবারের সদস্য।
সাত বছরের শিশুটিকে বাসায় রেখে তার মা–বাবা প্রতিদিন সকালে কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান। বাবা প্লাস্টিকের কারখানায় আর মা একটি স্কুলে আয়ার কাজ করেন। রাজধানীর লালবাগ এলাকায় টিনের ছাউনির ছোট্ট ঘরে একাই সময় কাটে তার।
শিশুটির নানি তাদের বাসার কাছেই থাকেন। কাজের ফাঁকে তিনিও নাতনির খোঁজ নেন। গত ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যার দিকে নানি এসে দেখতে পান বাসার দরজা বন্ধ। তিনি বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করার পর দরজা খুলে শিশুটির এক প্রতিবেশী বেরিয়ে যান। নানি ভেতরে ঢুকে দেখেন, শিশুটি ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে, থেমে থেমে কাঁদছে। কী ঘটেছে তা বুঝতে সময় লাগেনি নানির। দ্রুত শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে (ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার) নিয়ে যান স্বজনেরা। পরে শিশুটির বাবা বাদী হয়ে লালবাগ থানায় ধর্ষণ মামলা করেন। পুলিশ অবশ্য দ্রুতই আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে।
উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরা ধর্ষণের মতো অপরাধের শিকার হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলা-মোকদ্দমায় যেতে চায় না। গরিব মানুষ থানায় ও আদালতে মামলা করে। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ভুক্তভোগীর পরিবার মামলা করলেও শেষ পর্যন্ত চাপে পড়ে আপস করে ফেলে। এর ফলে অপরাধীর শাস্তি হয় না, ধর্ষণের ঘটনাও থামে না।
শিশুটির বাবা প্রথম আলোকে বলেন, কাজের জন্য তাঁরা স্বামী–স্ত্রী সব সময় বাইরে থাকেন। এই সুযোগই নিয়েছে প্রতিবেশী রজ্জব তালুকদার। তার মেয়ে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, চিকিৎসার পর তার মেয়ে শারীরিকভাবে এখন অনেকটাই সুস্থ। কিন্তু যে ক্ষতি হয়েছে, সেটি কীভাবে পূরণ হবে? তিনি আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছেন।
ধর্ষণের এ ঘটনাসহ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গত ১০ মাসে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় রাজধানীর ৫০টি থানায় মামলা হয়েছে ৫২৫টি। এর মধ্যে শিশু-কিশোরী ধর্ষণের মামলা প্রায় অর্ধেক (২৩৫টি)। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীদের ৪৫ শতাংশই শিশু–কিশোরী, যাদের বয়স ৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। মোট ৫২৫টি মামলার মধ্যে ১৮৬টি মামলার নথি পর্যালোচনা করেছে প্রথম আলো।
এসব মামলার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের একটি বড় অংশকে প্রতারিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বিয়ের আশ্বাস ও প্রেমের ফাঁদে ফেলা (ধর্ষণ ও দলবদ্ধ শিকার) হয়েছে ৬৪ শতাংশ নারীকে। ধর্ষণের শিকার হওয়া শিশু–কিশোরী ও নারীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রেও একটি মিল পাওয়া যায়। বেশির ভাগ ধর্ষণের ঘটনাতেই ভুক্তভোগী এবং আসামি উভয়ে নিম্ন আয়ের মানুষ।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীদের ৪৫ শতাংশই শিশু–কিশোরী, যাদের বয়স ৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। মোট ৫২৫টি মামলার মধ্যে ১৮৬টি মামলার নথি পর্যালোচনা করেছে প্রথম আলো।
অনুসন্ধানে উঠে আসা তথ্য নিয়ে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সাবেক ও বর্তমান পাঁচজন সরকারি কৌঁসুলির (পিপি) সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো।
তাঁরাও নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে মনে করেন, ঢাকায় যারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তাদের বড় অংশই শিশু–কিশোরী এবং নিম্ন আয়ের পরিবারের সদস্য। আবার ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত আসামিদেরও বড় অংশই দরিদ্র।
পাঁচজন সরকারি কৌঁসুলির এমন অভিমতকে সঠিক বলেই মনে করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার।
দীর্ঘদিন ধরে আদালতে ধর্ষণের শিকার নারীদের পক্ষে আইনি সহায়তা দিয়ে আসা এই আইনজীবী প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিকভাবে যাদের অবস্থান সুসংহত নয়, তাদের নানা ধরনের ফাঁদে ফেলা হয়। গরিব পরিবারের একটি শিশুকে চকলেট, আইসক্রিম বা টাকার লোভ দেখিয়ে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করে নিতে পারে ধর্ষকেরা। আবার ওই সব লোকজন তাদের পরিচিত হয় বা আশপাশেই বসবাস করে।
এর আগে ২০১৮ সালে প্রথম আলোর দীর্ঘ অনুসন্ধানেও একই তথ্য উঠে আসে। তখন প্রথম আলো ধর্ষণসংক্রান্ত ৫২টি মামলা খুঁটিয়ে দেখে। এর মধ্যে ৪৬টি মামলার ভুক্তভোগী নারীরা ছিলেন দরিদ্র পরিবারের, ছিন্নমূল, বস্তিবাসী, গৃহকর্মী, শ্রমজীবী বা পোশাকশ্রমিক। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণসহ ছয় ধরনের অপরাধে করা মামলা নিয়ে ২০১৮ সালের ৮ মার্চ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত মোট ছয়টি পর্বে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। ওই অনুসন্ধানেই উঠে আসে ৯৭ শতাংশ মামলায় আসামিদের সাজা হয় না।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আশপাশের মানুষেরাই ধর্ষণের ঘটনার জন্য দায়ী। নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মা–বাবারা যখন কাজে বেরিয়ে পড়েন, তখন তাঁদের সন্তানেরা ঝুঁকিতে থাকে।
এক যুগের বেশি সময় ধরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পিপির দায়িত্ব পালন করছেন এম এ বারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আশপাশের মানুষেরাই ধর্ষণের ঘটনার জন্য দায়ী। নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মা–বাবারা যখন কাজে বেরিয়ে পড়েন, তখন তাঁদের সন্তানেরা ঝুঁকিতে থাকে।
করোনায় সাধারণ ছুটির ৬৬ দিনে মামলা কম গত ৬ মার্চ রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকায় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী একটি শিশু (৭) ধর্ষণের শিকার হয়। শিশুটির মা পিঠা বিক্রি করে সংসার চালান। ৬ মার্চ বিকেলে পিঠা বিক্রির জন্য তিনি বাইরে যান। রাত ১০টায় ফিরে দেখেন ঘরে মেয়ে নেই। আশপাশের বিভিন্ন জায়গায় মেয়েকে খুঁজতে থাকেন।
পরে কামরাঙ্গীরচরে ইসলামনগরে একটি ভাঙারি দোকানের পাশে মেয়েকে খুঁজে পান তিনি। শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। এ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামির বয়স ৪০ বছর। এই আসামি এখন কারাগারে রয়েছেন।
কামরাঙ্গীরচরেই গত ১৮ অক্টোবর ১২ বছর বয়সী এক শিশু দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় তার মা বাদী হয়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আসামিদের মধ্যে চারজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা গত ২০ অক্টোবর অপরাধ স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
রাজধানীর চারটি থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্ব পালন করা কাজী ওয়াজেদ আলী (বর্তমানে পল্লবীর ওসি) প্রথম আলোকে বলেন, নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশু-কিশোরী সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। যারা আসামি, তারাও নিম্ন আয়ের মানুষ। বেশির ভাগ শ্রমিক।
জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ধর্ষণ মামলার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মার্চের শেষ সপ্তাহ ধেকে রাজধানীতে ধর্ষণের ঘটনা কমে আসে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দেশে সাধারণ ছুটি ছিল। ওই সময়ে (এপ্রিল ও মে মাসে) রাজধানীর ৫০ থানায় ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩৪টি। তবে ছুটি শেষে মামলার সংখ্যা বেড়ে যায়। জুন মাসে মামলা হয়েছে ৬৪টি। আর গত অক্টোবর মাসে মামলা হয়েছে ৯৩টি।
বিয়ের আশ্বাসে ও ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ বেশি
রাজধানীর একটি বেসরকারি কলেজের ছাত্রী গত ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রাবাড়ী থানায় ধর্ষণের মামলা করেন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছেন, এক যুবকের সঙ্গে পাঁচ বছর আগে তাঁর পরিচয় হয়। পরে তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ছেলেটি তাঁকে বিয়ে করার আশ্বাস দিয়ে ধর্ষণ করেছিল। প্রায় একই ধরনের একটি মামলা হয়েছে শেরেবাংলা নগর থানায়। ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী গত ৩ অক্টোবর মামলাটি করেন।
এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ফেসবুকের মাধ্যমে এক যুবকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এরপর সম্পর্ক তৈরি হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর একটি হোটেলে নিয়ে কোমলপানীয়র সঙ্গে নেশাজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে তাঁকে খাওয়ানো হয়। এরপর ওই যুবক তাঁকে ধর্ষণ করেন এবং তা ভিডিও করেন। পরে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
ঢাকার ৩ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি মাহমুদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, প্রেম, চাকরি ও বিয়ের আশ্বাসে ধর্ষণের মামলা বেশি হয় ঢাকায়। এখন দেখা যাচ্ছে ধর্ষণের ঘটনার ভিডিও করে রাখছে অপরাধীরা। ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের ঘটনাও ঘটছে।
সংসারে সচ্ছলতা আনতে লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকরি খুঁজছিল পল্লবী এলাকার দশম শ্রেণির এক ছাত্রী। গত ১৫ অক্টোবর তার মুঠোফোনে একটি কল আসে। বলা হয়, বায়িং হাউসে লোক নিয়োগ দেওয়া হবে। লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকরিও করা যাবে। সরল বিশ্বাসে ওই ব্যক্তির কথামতো গত ১৬ অক্টোবর চাকরির সাক্ষাৎকার দিতে একটি অফিসে যায়। সেখানে কোমলপানীয়র সঙ্গে চেতনানাশকদ্রব্য মিশিয়ে তাকে পান করানো হয়। পরে তাকে ধর্ষণ করা হয়।
এ ঘটনায় করা মামলায় পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। ওই ছাত্রীর বাবা সবজি বিক্রেতা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। কোনো কিছুতেই এখন তার আগ্রহ নেই। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত তিনি।
ধর্ষণসংক্রান্ত অপরাধ না কমার পেছনে সাজা না হওয়াকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। জ্যেষ্ঠ ফৌজদারি আইনজীবী আরফান উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষণসংক্রান্ত অপরাধের মামলায় সাজা একেবারেই কম। ধর্ষণ করার পরও একজন অপরাধীর যদি শাস্তি নিশ্চিত না করা যায়, খালাস পেয়ে যায়, তাহলে সমাজে কী বার্তা যায়। বার্তা যায় এই যে ধর্ষণ করলে কিছুই হবে না।
বেশির ভাগ ধর্ষণকারীর শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করেছে সরকার। গত ১৩ অক্টোবর থেকে আইনটি কার্যকর হয়েছে।
নতুন সাজা কার্যকর হওয়ার পর গত ১৪ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত ধর্ষণের সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ সময়ে ১৭১টি ঘটনায় ১৮৩ জন ধর্ষণের শিকার হন, যা আগের এক মাসের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নেহাল করিম প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরা ধর্ষণের মতো অপরাধের শিকার হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলা-মোকদ্দমায় যেতে চায় না। ঘটনা চেপে যায়। আপস করে ফেলে। ভাবে মামলা করলে সমাজিক মর্যাদাহানি হবে। আর ধর্ষণের শিকার হয়ে গরিব মানুষ থানায়, আদালতে মামলা করে। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভুক্তভোগীর পরিবার মামলা করলেও শেষ পর্যন্ত চাপে পড়ে আপস করে ফেলে। এর ফলে অপরাধীর শাস্তি হয় না, ধর্ষণের ঘটনাও থামে না।