ভিসা জালিয়াতিতে সরকারি কর্মকর্তা
আফ্রিকার একাধিক দেশের নাগরিকদের দেওয়া জাল ভিসায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তার স্বাক্ষর পাওয়া যাচ্ছে। ওই কর্মকর্তা একসময় কেনিয়ার নাইরোবিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কাজ করতেন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে তাঁর তিনটি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ২৩ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে।
এই সরকারি কর্মকর্তার নাম জাকির হোসেন। ২০০৯ সালের ৩১ আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত তিনি কেনিয়ার নাইরোবিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার ভিসা ইস্যু করার এখতিয়ার নেই। কিন্তু জাকির হোসেন তখনকার হাইকমিশনের অনুমোদনে সেখানে বছরের পর বছর ভিসা ইস্যু করেছেন। আর এখন নাইরোবি দূতাবাস থেকে ইস্যু দেখানো যেসব জাল ভিসা ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়ছে, সেগুলোতেও স্বাক্ষর জাকির হোসেনের।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কর্মকর্তারা বলছেন, জাকির হোসেন ২০১৯ সালের ২৩ জুন বদলি হয়ে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। কিন্তু দেশে ফিরে এসেও জাল ভিসার ব্যবসা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের পাসপোর্ট দালালের মাধ্যমে সংগ্রহ করেন এবং জাল ভিসা সংযুক্ত করে তা বহুজাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেন নাইজেরিয়ার নাগরিক ক্যামো প্রিন্স।
জাকির হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৯২ সালে অফিস সহকারী হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। বাগেরহাট শহরের বাসাবাটিতে তাঁর বাড়ি।
পুলিশ সূত্র জানায়, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, তানজানিয়া, গিনি, ঘানা, মালি, কেনিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক ব্যবসায়িক বা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে প্রতারণাসহ নানা অপরাধে যুক্ত হন। এ ধরনের বিদেশি সংঘবদ্ধ চক্র এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রতারণাসহ বিভিন্ন মামলা হয়েছে ১৫৭ জনের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে এখন বিভিন্ন কারাগারে আছেন ৮৬ জন।
জাকির যেভাবে নজরে এলেন
২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর নাইজেরিয়া থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুল হয়ে চারজন নাইজেরিয়ান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন। তাঁদের কাগজপত্র যাচাইয়ের সময় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়। তাঁদের সবার ভিসায় স্বাক্ষর ছিল জাকির হোসেনের। পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) তদন্ত করে টাকার বিনিময়ে জাল ভিসা দেওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ওই চার নাইজেরিয়ানকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
এসবির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নাইজেরিয়ার চার নাগরিক জিজ্ঞাসাবাদে এসসিও (ডিপ্লোমেটিক অ্যান্ড প্রটোকল) শাখা কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন, নাইজেরিয়া থেকে ভিসা পাওয়া কষ্টসাধ্য হওয়ায় তাঁরা এজেন্টের মাধ্যমে পাসপোর্ট পাঠিয়ে কেনিয়ার নাইরোবি থেকে ভিসা সংগ্রহ করেন। কিন্তু নাইজেরিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশন থাকায় কোনো নাইজেরিয়ানের কেনিয়া থেকে ভিসা নেওয়া নিয়মবহির্ভূত। পরে ভিসাগুলোর বিষয়ে নাইরোবিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ই-মেইলে যোগাযোগ করলে কর্তৃপক্ষ তাঁদের জানায়, এগুলো জাল এবং তাদের দূতাবাস থেকে ইস্যু হয়নি।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন সম্পর্কে জানতে চাইলে জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কেনিয়ায় হাইকমিশনে কাজ বেশি না থাকায় তিনি সেখানে গাড়ির ব্যবসা শুরু করেন। সেই ব্যবসা থেকে পাওয়া টাকা তিনি বিভিন্ন সময়ে দেশে তাঁর ব্যাংক হিসাবে পাঠিয়েছেন।
সম্প্রতি ঢাকার নিকুঞ্জ ও বসুন্ধরা এলাকায় অবৈধ বিদেশি শনাক্তে অভিযান পরিচালনাকালে একটি ক্যামেরুন এবং দুটি নাইজেরিয়ান পাসপোর্ট জব্দ করে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)। তিনটি পাসপোর্টেরই ভিসায় কনস্যুলার অফিসার হিসেবে জাকির হোসেনের সই রয়েছে। এর মধ্যে ইফেচুকু এলেন আমাফের নামের একজনের ভিসা ইস্যুর তারিখ গত বছরের ১০ মার্চ।
আর ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর বিমানবন্দরে আটক চার নাইজেরিয়ানের মধ্যে একজনের ভিসা ইস্যুর তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি।
নাইরোবি হাইকমিশনের দূতালয় প্রধান সায়েম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রায়ই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাঁদের কাছে বিভিন্ন ব্যক্তির ভিসার তথ্য জানতে চাওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘জাল ভিসাগুলো সবই স্ট্যাম্পে দেওয়া হয়েছে। আর আমরা দিচ্ছি মেশিন রিডেবল ভিসা।’
জাকির হোসেন যখন নাইরোবিতে ছিলেন, তখন হাইকমিশনার ছিলেন আবুল কালাম মো. হুমায়ুন কবীর। প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে ভিসা ইস্যুর দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সেখানে ভিসা ইস্যু করার মতো কূটনৈতিক কর্মকর্তা না থাকায় জাকিরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তবে সেটা অল্প কিছুদিনের জন্য।
অবশ্য জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কেনিয়ায় যাওয়ার পর ২০১০ সালে তিনি সেখানকার কনস্যুলারের পুরো দায়িত্ব পান। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে তাঁকে ভিসায় সই করার ক্ষমতা দেন তৎকালীন হাইকমিশনার।
জাল ভিসা ব্যবসার অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে জাকির হোসেনকে ফোন দিলে ফোনটি ধরেন তাঁর ছোট ভাই জাহিদ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জাকির হোসেন এখন আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ায় আছেন। কয়েক ঘণ্টা পর জাকির হোসেন অ্যাপভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে অন্য একটি নম্বর থেকে এই প্রতিবেদককে কল করেন। দাবি করেন, তিনি তানজানিয়ার জাঞ্জিবারে আছেন। জাল ভিসা দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, প্রতিটি ভিসাই তিনি তখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের অনুমতিতে দিয়েছেন।
একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেন খুবই অস্বাভাবিক। বিষয়টি ভালোমতো তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন হাইকমিশনারের কোনো গাফিলতি ছিল কি না, সেটাও তদন্ত করা উচিত।তৌহিদ হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব
ব্যাংকে কোটি টাকার লেনদেন
জাকির হোসেনের নামে বাগেরহাটের একটি বেসরকারি ব্যাংকে তিনটি হিসাবের খোঁজ পাওয়া গেছে। আরও ব্যাংক হিসাব থাকতে পারে বলে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মনে করছে। একটি সূত্র থেকে তিনটি ব্যাংক হিসাবের বিবরণী সংগ্রহ করে দেখা গেছে, একটি সঞ্চয়ী হিসাবে ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১ কোটি ৬৫ লাখ ৬৮ হাজার ৯০৪ টাকা জমা হয়েছে। এর মধ্যে ২১ কোটি ১৫ লাখ ৮৭ হাজার ৩৮১ টাকা তিনি বিভিন্ন সময় তুলেও নিয়েছেন।
বাকি দুটি মাসিক মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়ী হিসাব। ২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একটি হিসাবের বিপরীতে তিনি ৭৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনেন। তিন বছর পর ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মুনাফাসহ ৯১ লাখ ৮৮ হাজার ৬০০ টাকার পুরোটাই তুলে নিয়ে যান। আরেকটি হিসাবের বিপরীতে ৪৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনেন ২০১৫ সালের এপ্রিলে। তিন বছর পর মুনাফাসহ ৬২ লাখ ৭৩ হাজার ৮০০ টাকা তুলে নেওয়া হয়।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন সম্পর্কে জানতে চাইলে জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কেনিয়ায় হাইকমিশনে কাজ বেশি না থাকায় তিনি সেখানে গাড়ির ব্যবসা শুরু করেন। সেই ব্যবসা থেকে পাওয়া টাকা তিনি বিভিন্ন সময়ে দেশে তাঁর ব্যাংক হিসাবে পাঠিয়েছেন।
সরকারি চাকরি করে ব্যবসা করতে পারেন কি না, জানতে চাইলে জাকির হোসেন বলেন, ব্যবসা করা যাবে না, এমন কিছু তাঁর জানা নেই।
স্ট্যান্ড রিলিজের পরও দায়িত্ব পালন
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ভিসাসহ নানা জাল-জালিয়াতির কারণে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাকির হোসেনকে নাইরোবি থেকে ‘স্ট্যান্ড রিলিজ’ করে ঢাকায় তলব করেছিল। তারপরও জাকির হোসেন ছয় মাস সেখানে দায়িত্ব পালন করেন।
তখন কেনিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন আবুল কালাম মো. হুমায়ুন কবীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জাকির হোসেন ভিসা জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এমন কোনো তথ্য তাঁর জানা নেই।
স্ট্যান্ড রিলিজের পর জাকির আরও ছয় মাস কীভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন? এ প্রশ্নের জবাবে আবুল কালাম মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, জাকির অসুস্থ ছিলেন, মেডিকেল বোর্ডের এমন মতামতের ভিত্তিতেই তিনি সেখানে থেকেছেন।
জাকির হোসেন দাবি করেন, তিনি তানজানিয়ার জাঞ্জিবারে আছেন। জাল ভিসা দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, প্রতিটি ভিসাই তিনি তখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের অনুমতিতে দিয়েছেন।
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, সেই সময়ও জাকির ভিসা ইস্যু করেছেন। তিনি অসুস্থ ছিলেন হিসাবে চিকিৎসা-সংক্রান্ত যেসব প্রমাণ দিয়েছেন, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তাই সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে।
জাকির হোসেন দাবি করেন, তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে লিয়েনে ছুটি নিয়ে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস হ্যাবিটেটে কাজ করছেন এবং তানজানিয়ায় অবস্থান করছেন। আবুল কালাম মো. হুমায়ুন কবীর ইউএন হ্যাবিটেটের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেই সূত্রে জাকিরও এখানে কাজ পান।
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, বিভিন্ন অভিযোগে জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত চলছে। এ সময় লিয়েন-সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেন খুবই অস্বাভাবিক। বিষয়টি ভালোমতো তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন হাইকমিশনারের কোনো গাফিলতি ছিল কি না, সেটাও তদন্ত করা উচিত।