আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট: ভাষা গবেষণায় পিছিয়ে
বাংলা ভাষার প্রচার-প্রসারসহ পৃথিবীর সব মাতৃভাষা সংরক্ষণ, গবেষণা ও বিকাশের লক্ষ্যে ১১ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। তবে এই কয় বছরে কিছু সেমিনারের আয়োজন, স্মরণিকা ও নিউজলেটার প্রকাশ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ নেই। দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে গবেষণা তাদের একমাত্র বড় কাজ। চার বছর আগে কাজটি শেষ হলেও এখন জানা যাচ্ছে, সেই কাজও অসম্পূর্ণ।
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান। ভাষা–গবেষকেরা বলছেন, বাংলা ভাষাসহ দেশের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে গবেষণার যে কাজ করার কথা, তাতে প্রতিষ্ঠানটি সফল হয়নি। বিদেশে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারেও এই ইনস্টিটিউটের উল্লেখযোগ্য কাজ নেই। তাঁরা বলছেন, কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত হলে স্বাধীনভাবে কাজ ও গবেষণা করতে পারে না।
অবশ্য ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে ঘিরে বছরে একবার করে প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করেছে। এর বাইরেও বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া একটি মাতৃভাষা জাদুঘর ও বিশ্বের লিখনবিধি আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করেছে ইনস্টিটিউটটি। তবে এগুলো নিয়ে প্রচারও কম।
২০১০ সালের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন অনুযায়ী, এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ২৩টি। এর মধ্যে আছে দেশে ও দেশের বাইরে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নেওয়া, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ক্ষুদ্র জাতিসমূহের ভাষা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, এতৎসংক্রান্ত গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা, ভাষা বিষয়ে গবেষণা-জার্নাল প্রকাশনা, সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন, বিভিন্ন ভাষা ও বর্ণমালার জন্য একটি আর্কাইভ নির্মাণ, সংরক্ষণ ও পরিচালনা, ভাষা বিষয়ে একটি জাদুঘর নির্মাণ, আন্তর্জাতিক মানের লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা করা। ভাষা–গবেষকেরা বলছেন, এসব লক্ষ্যের কিছু কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা আন্দোলন বিষয়ে গবেষণা ও ইউনেসকোর সদস্যদেশগুলোর মধ্যে এ–সংশ্লিষ্ট ইতিহাস প্রচার, বাংলাসহ পৃথিবীর সব ভাষার বিবর্তনবিষয়ক গবেষণা, বিভিন্ন ভাষা বিষয়ে অভিধান বা কোষগ্রন্থ প্রকাশ এবং হালনাগাদ করা, ভাষা বিষয়ে গবেষণার জন্য দেশি ও বিদেশিদের ফেলোশিপ দেওয়া, ভাষা বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বৃত্তি দেওয়া, ভাষা বিষয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়া চ্যানেল স্থাপন করা—এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
২০১৩ সালের নভেম্বরে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শুরু হয় দেশের ভাষা পরিস্থিতি ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভাষা পরিস্থিতি নিয়ে আঞ্চলিক পর্যায়ে সেমিনার এবং গবেষণার কাজ। সে বছর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা-পরিচিতি: মৌলভীবাজার নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। তবে অন্য জেলার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা পরিচিতি নিয়ে আর কোনো গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি।
ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবে চলতি দায়িত্ব পালন করছেন মো. বেলায়েত হোসেন তালুকদার। বাংলা ভাষার প্রচারে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কত দূর এগোল, গবেষণার অগ্রগতি কম কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে মহাপরিচালক না থাকায় আমি গ্যাপ পূরণের কিছু কাজ করছি। আমি মন্ত্রণালয় থেকে এসেছি। তথ্য দেওয়ার মতো যথাযথ ব্যক্তি আমি না।’ এসব বিষয় নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে আলাপ করার পরামর্শ দেন তিনি।
একমাত্র বড় কাজ অসম্পূর্ণ
গত ১১ বছরে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের একমাত্র বড় কাজ নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা। দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষা-পরিস্থিতি ও ভাষিক সম্প্রদায়ের অবস্থান জানতে ২০১৩ সালে এ সমীক্ষা শুরু হয়। এটির মাঠপর্যায়ে কাজ শেষ হয় ২০১৬ সালে। এ কাজে সরকারের খরচ হয়েছে ৩ কোটি ২১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৮৭ টাকা। পরিকল্পনা ছিল, এ সমীক্ষা শেষ করে তা ১০ খণ্ড বাংলায় ও ১০ খণ্ড ইংরেজিতে প্রকাশ করা হবে। সমীক্ষার প্রথম খণ্ডটি বই আকারে প্রস্তুত হয় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সে বছর প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে সমীক্ষাটি উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি এখনো প্রকাশিত হয়নি।
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সমীক্ষার প্রথম খণ্ডের কাজ এখনো অসম্পূর্ণ। ওই খণ্ডের ভাষাবিজ্ঞান অংশের কাজ শেষ হলেও নৃতাত্ত্বিক অংশের কিছু কাজ বাকি আছে। কাজ শেষ করে কবে প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হবে, সে বিষয়েও তাঁদের কাছে কোনো নির্দেশনা নেই।
জানতে চাইলে ইনস্টিটিউটের পরিচালক (ভাষা, গবেষণা ও পরিকল্পনা) মো. শাফীউল মুজ নবীন প্রথম আলোকে বলেন, নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার প্রথম খণ্ডের কিছু কাজ বাকি আছে। বাংলায় এটি প্রকাশিত হওয়ার পর ইংরেজিতে প্রকাশ করা হবে। এই পাণ্ডুলিপি সবগুলো নেই। কিছু পাণ্ডুলিপি এসেছে। তবে নৃতাত্ত্বিক অংশের আরও পাণ্ডুলিপি তৈরি বাকি আছে। তিনি বলেন, ‘এই বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার পরবর্তী কার্যক্রমের কোনো নির্দেশনা পাইনি। তখন কাজটি প্রকল্পের অধীনে হয়েছিল। ফলে এটি প্রকাশিত হয়নি।’
নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ শিকদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার তিন খণ্ডের ভাষাবিজ্ঞান অংশের কাজ শেষ হয়েছে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এগুলো প্রকাশ করেনি, অনুবাদ করার কাজও করেনি। তাদের কাছে জানতে চাইলেও কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা বা সদুত্তর পাইনি।’
সেমিনার ও প্রকাশনাও অনিয়মিত
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৯টি আন্তর্জাতিক সেমিনার এবং ২৬টি জাতীয় সেমিনার করেছে। এসব সেমিনার মূলত আয়োজন করা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আগে-পরে বা দিবসের দিনে। দিবসটি উপলক্ষে একটি করে স্মরণিকাও প্রকাশিত হয়। যাত্রা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট একুশের স্মরণিকা প্রকাশ করেছে ১১টি।
২০১৩ সালের মার্চে এ ইনস্টিটিউট থেকেই প্রথম মাতৃভাষা-বার্তা প্রকাশিত হয়। ২০২১ সালের এপ্রিল-জুন পর্যন্ত ১৫টি মাতৃভাষা–বার্তা বেরিয়েছে। প্রতি তিন মাস অন্তর তা প্রকাশিত হওয়ার কথা। তবে একেকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয় তিন মাস থেকে এক বছর সময়ের ব্যবধানে। এ প্রতিষ্ঠানেরই আরেকটি প্রকাশনা আইএমএলআই নিউজলেটার। প্রথমটি প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। সর্বশেষ সংখ্যাটি ২০১৮ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরের। এটিও তিন মাস অন্তর প্রকাশ হওয়ার কথা। তবে এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে কেবল তিনটি সংখ্যা।
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের আছে ষাণ্মাসিক গবেষণা পত্রিকা মাতৃভাষা পত্রিকা। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ছয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের আরেকটি কাজ হচ্ছে প্রতি ছয় মাস পরপর ইংরেজি ভাষায় মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ প্রকাশ করা। ষাণ্মাসিক গবেষণার এ পত্রিকার কেবল দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের পরে এটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা বলছেন, ভাষা নিয়ে দেশে গবেষণা কম হয়, গবেষকের সংখ্যাও কম। ভালো মানের মৌলিক লেখার অভাবে এসব প্রকাশনা বের হতে বিলম্ব হয়। মৌলিক লেখা ও গবেষণা কার্যক্রমকে জোর দিতে একটি গবেষণা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। নীতিমালাটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেয়েছে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
পরিচালক শাফীউল মুজ নবীন মনে করেন, নীতিমালাটি অনুমোদন হলে গবেষণা ও প্রকাশনার কাজের সুযোগ ও সম্প্রসারণ বাড়বে।
যা করণীয়
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ বাঙালির অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন পাস হয়। এক বছর আগে, ২০১১ সালের মাঝামাঝি শুরু হয় জনবল নিয়োগ ও ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠানটির জনবলকাঠামোতে ১৭টি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার পদসহ ৯৮টি অনুমোদিত পদ আছে। কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে ছিল জনবলসংকট। গত দুই বছরে ২০ জনের নিয়োগ হওয়ায় এ সংকট কিছুটা কমেছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ১৪ জন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাসহ ৬০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানে সরকারের ব্যয় হয়েছে ২১ কোটি ৪২ লাখ ২০ হাজার ৪৭৪ টাকা।
ভাষা–গবেষক ও রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিশ্বজিৎ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, পৃথিবীর বিলুপ্ত ও বিপন্নপ্রায় ভাষা রক্ষা, গবেষণা এবং তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে এসব ভাষা সংরক্ষণ করার কথা মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটটির। দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণে ইনস্টিটিউটের একমাত্র কাজটিও দৃশ্যমান হয়েছে বলে জানা যায়নি। যে স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও লক্ষ্য নিয়ে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার ধারেকাছেও প্রতিষ্ঠানটি যেতে পারেনি।
এই ভাষা–গবেষক মনে করেন, ভাষা সংরক্ষণ ও গবেষণায় মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের দক্ষতা ও সদিচ্ছার অভাব আছে। মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত বলেই এই প্রতিষ্ঠান আমলাতান্ত্রিক। আর আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। একটা সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম জোরালো করা দরকার। কারণ, ভাষা গবেষণায় সচল প্রতিষ্ঠান হিসেবে সারা পৃথিবীতে পরিচিতি পেতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সুযোগ আছে।