পাবনার ঈশ্বরদীতে বর্তমানে ব্রিটিশ স্থাপনার আধিপত্য ম্রিয়মাণ। নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশদের গড়া শহরটি বদলে যাচ্ছে রাশিয়ানদের পদচারণে। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ইমারত, হাসপাতাল, রিসোর্ট, বিনোদনকেন্দ্র, বিপণিবিতানসহ নানা স্থাপনা। যে বদলের ছোঁয়া লেগেছে পুরো জেলায়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অনেকের।
ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় যাতায়াত সহজ করতে ব্রিটিশদের শাসনকালে পদ্মা নদীর দক্ষিণে দামকুদিয়া ঘাট থেকে উত্তরে সারাঘাট (বর্তমান ঈশ্বরদী) পর্যন্ত রেলসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯১০ সালে শুরু হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নির্মাণকাজ। এই সময়ই ঈশ্বরদীতে নির্মিত হয় দেশের প্রথম রেলওয়ে জংশন স্টেশন, রেলওয়ের কার্যালয়, কোয়ার্টারসহ নানা স্থাপনা। ১৯১৫ সালে একযোগে চালু হয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও রেলওয়ে জংশন। ব্রিটিশদের হাত ধরেই নতুনরূপে সাজতে থাকে ঈশ্বরদী উপজেলা। তৈরি হয় ঈশ্বরদী বিমানবন্দর। নিভৃত এক পল্লি পরিণত হয় আলোকোজ্জ্বল শহরে।
গ্রাম থেকে শহর
বর্তমানে ঈশ্বরদীর রূপপুরে বাস্তবায়নাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প দিন দিন শহরে পরিণত করছে আশপাশের গ্রামগুলোকে। বদলে দিয়েছে গ্রামের দৃশ্যপট। মূল প্রকল্পটি পদ্মা নদীর তীরঘেঁষা রূপপুর গ্রামে। প্রকল্পের আবাসিক এলাকা গ্রিনসিটি নির্মিত হয়েছে পাশের দিয়াড় সাহাপুর গ্রামে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, ব্রিটিশ আমলে পুরো এলাকাটি ছিল জঙ্গলময়। দিনের আলোতেও এখানে মানুষ চলাচল করতে ভয় পেত। প্রথম ব্রিটিশরাই এলাকাটি পরিষ্কার করেছিলেন। দক্ষিণের সঙ্গে উত্তরের যোগাযোগ সৃষ্টি করতে তাঁরা তৈরি করেছিলেন রেললাইনসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বর্তমানে প্রায় তিন হাজার রাশিয়ানের পদচারণে মুখর পুরো এলাকা। তাঁদের জন্য বড় বড় ইমারত যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি বিপণিবিতান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, হাসপাতাল ও বিনোদনকেন্দ্র তৈরি হয়েছে দিয়াড় সাহাপুর গ্রামে। রাশিয়ানদের চাহিদা বিবেচনায় আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে হচ্ছে হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট। এসব প্রতিষ্ঠানের নামও দেওয়া হয়েছে রাশিয়ান ভাষায়। ফলে হঠাৎ করে দেখলে এখন গ্রামটিকে এক খণ্ড রাশিয়া মনে হতে পারে।
ঈশ্বরদী উপজেলা সদর ও পাবনা জেলা সদরেও লেগেছে এই উন্নয়নের ছোঁয়া। শপিং মল, সুপারশপ ও রেস্টুরেন্ট তৈরির যেন হিড়িক পড়েছে। রাশিয়ানদের চাহিদার কথা বিবেচনা করেই ঈশ্বরদীতে নতুন করে ৩টি রিসোর্ট, প্রায় ৮টি রেস্টুরেন্ট, ১৫টি বেসরকারি হাসপাতাল, ৫টি মল তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে জেলা সদরে একটি হাসপাতাল, দুটি রিসোর্ট ও নতুন করে অন্তত পাঁচটি রেস্টুরেন্ট তৈরি হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে স্থানীয় অনেকের। অন্যদিকে রূপপুর প্রকল্পে কর্মস্থান হয়েছে জেলার প্রায় ১০ হাজার মানুষের। ফলে ব্যক্তি–উন্নয়নের ছোঁয়াও লেগেছে বিভিন্ন গ্রামেও।
সাহাপুর-রূপপুরে একদিন
মহাসড়ক ধরে পাবনা থেকে কুষ্টিয়ার দিকে যেত বাঁয়ে চরসাহাপুর, ডানে দিয়াড় সাহাপুর। দুই পাশে তাকালে চোখে পড়ে বদলের চিত্র। বাঁ দিকে লিচুবাগান আর গ্রামীণ কাঁচা–পাকা বাড়ি। ডানে বড় বড় ইমারত। মহাসড়ক থেকে ঢালু রাস্তা ধরে নামলেই দিয়াড় সাহাপুর গ্রাম। ছোট রাস্তার পাশেই ‘নতুন হাট’ নামে ছোট একটি বাজার। শাকসবজি, ফল, মাছ-মাংস নিয়ে বাজারে বসেছেন ক্রেতারা। শত শত রাশিয়ান ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাজারে। মনে হয়, রাশিয়ার কোনো শহরে বাঙালিরা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। বাজারটির চারপাশে সেলুন, রেস্টুরেন্ট, সুপারশপ, ক্যাফে, ক্লাবসহ আধুনিক সব দোকান। রাশিয়ান ভাষায় নাম দেওয়া হয়েছে এসব দোকানের।
সাহাপুর গ্রাম থেকে আবার পাবনা-কুষ্টিয়া মহাসড়ক ধরে একটু পথ। সামনে এগোলেই বিশাল কর্মযজ্ঞ। রাস্তার বাঁ দিকে বিশাল এলাকা নিয়ে তৈরি হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। সাইকেল, মোটরসাইকেলে শত শত কর্মী প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ করছেন, বের হচ্ছেন।
রূপপুর মোড়ে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা সাইফুর আজমের সঙ্গে। তিনি জানান, আগে ব্রিটিশদের তৈরি হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নামে দেশের মানুষ এই এলাকা চিনতেন। এখন পুরো এলাকার চিত্র পাল্টে গেছে। নতুন হাট বাজারে কথা হয় স্থানীয় প্রবীণ রবিউল বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি জানান, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হওয়ার পর এলাকাটিতে মানুষের বসতি বাড়তে থাকে। এরপর স্থানীয় কয়েকজন মিলে নতুন হাট নামে বাজারটি চালু করেন। প্রথম দিকে এই বাজারে রবি ও বুধবার শুধু ছাগল বিক্রি হতো। আশপাশের মানুষ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য বিক্রি শুরু হয়। রাশিয়ানরা আসার পর এখন প্রতিদিন বাজার বসছে।
বাজারে আয়নাল হোসেন প্রায় ১০ বছর ধরে মাছ বিক্রি করছেন। রাশিয়ানরা আসার পর তাঁর বিক্রি বেড়েছে। তবে প্রথম দিকে রাশিয়ানদের ভাষা বুঝতেন না। এখন রাশিয়ার ভাষা শিখে গেছেন। তবে বিড়ম্বনা হচ্ছে রাশিয়ানরা মাছটা কিনলেও মাছের মুড়োটা নিতে চায় না। ফলে মুড়ো আলাদা করে বিক্রি করতে হয়।
ভবিষ্যৎ শহর
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হবে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে। প্রকল্পে দুটি ইউনিটে ভিভিইআর রিঅ্যাক্টর থাকবে। প্রতি ইউনিটে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। ২ ইউনিট মিলে মোট উৎপাদন হবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। পুরো প্রকল্পটি শেষ হলে এই এলাকার চিত্র আরও বদলে যাবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট লোকজন। পুরো রূপপুর ও সাহাপুর হবে নতুন আধুনিক শহর।
প্রকল্পের সাইট ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুস জানান, পাঁচ বছর আগেও দিয়াড় সাহাপুর গ্রামে কোনো উঁচু ভবন ছিল না। বর্তমানে প্রকল্পের আবাসিক এলাকা গ্রিনসিটিতে ১৬টি দৃষ্টিনন্দন আধুনিক বহুতল ভবন হয়েছে। আরও পাঁচটি ভবন নির্মাণাধীন। অন্যদিকে রাশিয়ানদের চাহিদা বিবেচনায় বেসরকারিভাবে অনেক দৃষ্টিনন্দন হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট তৈরি হচ্ছে। ফলে প্রকল্পটি পুরোপুরি চালু হলে এলাকাটি একটি আধুনিক শহরে পরিণত হবে।