ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিষ্টি ছানামুখী
ওপরে হালকা চিনির আবরণ। ভেতরের পুরোটাই দুধের ছানা। দেখতে চতুর্ভুজ আকারের ছোট ছোট টুকরা এই মিষ্টান্নের নাম ছানামুখী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শত বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার। এই মিষ্টির সুনাম সারা দেশে।
বগুড়ার ঐতিহ্যের সঙ্গে যেমন দই, কুমিল্লার যেমন রসমালাই, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, মুক্তাগাছার মণ্ডা, টাঙ্গাইলের চমচম, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তেমনিই ছানামুখী। জেলা তথ্য বাতায়নে পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে উল্লেখ আছে এই ছানামুখীর নাম।
এক কেজি ছানামুখী তৈরিতে গাভির সাত–আট লিটার দুধ লাগে। প্রতি কেজি ছানামুখীর দাম ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা।
ছানামুখী মিষ্টির রয়েছে পুরোনো ইতিহাস। মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত যে ইতিহাস, তাতে এই মিষ্টির প্রবক্তার নাম মহাদেব পাঁড়ে। বাড়ি তাঁর ভারতের কাশিধামে। বড় ভাই দুর্গা প্রসাদের হাত ধরে আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ আগে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। বড় ভাইয়ের মিষ্টির দোকানে কাজ শুরু করেন মহাদেব। দুর্গা প্রসাদের মৃত্যুর পর আশ্রয়হীন হয়ে মহাদেব নিরুদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন। ঘুরতে ঘুরতে একসময় চলে আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে। বর্তমান জেলা শহরের মেড্ডায় তখন শিবরাম মোদকের একটি মিষ্টির দোকান ছিল। তিনি নিজের দোকানে মহাদেবকে আশ্রয় দেন। মহাদেব আসার পর শিবরামের মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মৃত্যুর সময় শিবরাম মিষ্টির দোকানটি মহাদেবকে দিয়ে যান। মহাদেব দুটি মিষ্টি বানাতেন। একটি লেডি ক্যানিং বা লেডি ক্যানি, অন্যটি ছানামুখী।
এখন জেলায় কয়েকটি দোকানে ছানামুখী মিষ্টি তৈরি হয়। স্বাদ প্রায় কাছাকাছি।
জেলা শহরের আদর্শ মিষ্টান্ন ভান্ডারে দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ধরে কাজ করছেন দুলাল চন্দ্র পাল (৬০)। সম্প্রতি কথা হলো তাঁর সঙ্গে। দুলাল বলেন, ৭ থেকে ৮ লিটার দুধের সঙ্গে এক কেজি চিনি দিয়ে তৈরি হয় এক কেজি ছানামুখী। তিনি ছানামুখী তৈরির কয়েকটি ধাপের কথা বললেন। প্রথমে গাভির দুধ জ্বাল দিতে হবে। এরপর গরম দুধ ঠান্ডা করে ছানায় পরিণত করতে হবে। অতিরিক্ত পানি ঝরে যাবে এমন একটি পরিচ্ছন্ন টুকরিতে ছানা রাখতে হবে। পরে ওই ছানাকে কাপড়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতে হবে, যাতে সব পানি ঝরে যায়। এভাবে দীর্ঘক্ষণ ঝুলিয়ে রাখলে ছানা শক্ত হবে। শক্ত ছানাকে ছুরি দিয়ে ছোট ছোট টুকরায় কাটতে হবে। এরপর চুলায় একটি কড়াই বসিয়ে তাতে পানি, চিনি ও এলাচি দিয়ে ফুটিয়ে শিরা তৈরি করতে হবে। এরপর ছানার টুকরাগুলো চিনির শিরায় ছেড়ে নাড়তে হবে। সব শেষে চিনির শিরা থেকে ছানার টুকরাগুলো তুলে একটি বড় পাত্রে রাখতে হবে। ওই পাত্রকে খোলা জায়গা বা পাখার নিচে রেখে নেড়ে শুকাতে হবে। এতেই প্রস্তুত হয়ে যাবে ছানামুখী।
আদর্শ মিষ্টান্ন ভান্ডার ছাড়াও জেলা শহরের মধুরাজ মিষ্টান্ন ভান্ডার, মাতৃ মিষ্টান্ন ভান্ডার, মহাদেব মিষ্টান্ন ভান্ডার, ভোলাগিরি মিষ্টান্ন ভান্ডার, ভোলানাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার, আনন্দময়ী মিষ্টান্ন ভান্ডারের ছানামুখী প্রসিদ্ধ।
১৪ বছর বয়স থেকে মিষ্টির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আদর্শ মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক রাখাল চন্দ্র মোদক (৭৪)। তাঁর ছেলে দুলাল চন্দ্র মোদকও ব্যবসা দেখাশোনা করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত চাহিদার ভিত্তিতে দুপুরে ছানামুখী প্রস্তুত করা হয়। ৭-৮ কেজি ছানামুখীর জন্য গাভির ৫০ থেকে ৫৫ কেজি দুধ লাগে। প্রবাসীরা দেশে বেড়াতে এলে যাওয়ার সময় এই মিষ্টি সঙ্গে করে নিয়ে যান। বিভিন্ন জেলা থেকেও মানুষ ছানামুখী কিনতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসেন। বাংলাদেশের আর কোথাও ছানামুখী তৈরি হয় না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষেরা সব সময় নিজেদের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি হিসেবে ছানামুখীর নাম উল্লেখ করে থাকেন। সে কথাই বলছিলেন জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক আব্দুন নুর, ‘সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলে ছানামুখী কিনে নিয়ে যান। আমরা আমাদের এই ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করি।’