পরিবারতন্ত্র কায়েম হতে যাচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকে। নতুন নিয়মে একই পরিবারের চারজন ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন। আর পরিচালকেরা ব্যাংকে থাকতে পারবেন একটানা নয় বছর।
মূলত প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যবসায়ীকে সুযোগ দিতেই এভাবে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হচ্ছে। বিদ্যমান আইনে অনেকেরই পরিচালক থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে আসছিল। এর মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালকদের কাছে নতি স্বীকার করল সরকার।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকে লুটপাটের দরজা খুলে দেওয়া হলো। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, অর্থশক্তির ক্ষমতা যে রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক শক্তিকে অতিক্রম করে গেছে, এই সংশোধনীর মাধ্যমে তা প্রমাণিত হলো; যা ব্যাংক খাতের জন্য খুবই খারাপ হবে।
গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভা ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০১৭-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে। বর্তমানে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ দুজন সদস্য একটি ব্যাংকের পরিচালক হতে পারেন। আর তিন বছর করে পরপর দুই মেয়াদে মোট ছয় বছর একই ব্যক্তি পরিচালক হতে পারেন। এরপর তিন বছর বিরতি দিয়ে আবারও পরিচালক হতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গতকাল সোমবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ-সংক্রান্ত তথ্য জানান।
বর্তমানে দেশে বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৪০। এসব ব্যাংকে উদ্যোক্তারা মূলধনের জোগান দিয়েছেন ১৬ হাজার কোটি টাকা। এসব ব্যাংকে এখন আমানতের পরিমাণ প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ, আমানতের তুলনায় উদ্যোক্তা-পরিচালকদের মূলধন মাত্র আড়াই শতাংশের সামান্য বেশি। অথচ তাঁরাই এখন ব্যাংকের মালিক হিসেবে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ ব্যবস্থা করে নিলেন।
সাবেক ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এর মাধ্যমে ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েম হবে, একেকটি পরিবারের হাতে জিম্মি হয়ে পড়বে ব্যাংকগুলো। আমানতকারীরাও জিম্মি হয়ে পড়বেন এসব পরিবারের কাছে। ব্যাংকের ঋণও যাবে এসব পরিবারে। পাকিস্তান আমলে যে ২২ পরিবার ছিল, তারও সৃষ্টি হয়েছিল ব্যাংক থেকে। নতুন সংশোধনীর কারণে পুরো বাংলাদেশই এমন কিছু পরিবারের হাতে জিম্মি হয়ে পড়বে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০১৩ পর্যন্ত সংশোধিত) ২০১৩ সালের ২২ জুলাই থেকে কার্যকর হয়। এ আইন অনুযায়ী চলতি বছরেই বেশির ভাগ পরিচালকের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। এ কারণে ২০১৬ সালের মধ্যভাগ থেকে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এই আইনের বেশ কিছু ধারা পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছে। বিএবি উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ক্ষেত্রে মেয়াদের বিষয়টি তুলে দেওয়ার দাবি জানায়। পাশাপাশি এক পরিবার থেকে দুজনের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না, এমন নিয়মও বাদ দিতে বলে।
সংশোধনী অনুমোদনের পর বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুশাসনের জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইনে এসব পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, এর ফলে ব্যাংক আরও গতিময় হবে। আমরা যারা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছি, বাইরের যে কারও চেয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বেশি। বাইরের কেউ তো ব্যাংকের গ্রাহককে চিনবে না।’
তবে গত বছরের মে মাসে বিএবি প্রথম এমন দাবি তোলার পর বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে সায় দেয়নি। পরিচালকের সংখ্যা এক পরিবার থেকে দুজনের বেশি না করার যুক্তি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়কে বলেছিল, এতে কোনো ব্যাংক একই পরিবারের মধ্যে কুক্ষিগত হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া পরিচালকদের মেয়াদ না বাড়িয়ে একজন পরিচালক যেন একাধারে দুই মেয়াদে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করতে পারেন, এ জন্য কিছু সংশোধনীর প্রস্তাব করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে কেউ ছয় বছরের কম সময় দায়িত্ব পালন করলেও তা পূর্ণ মেয়াদ হিসেবে গণ্য হওয়ার বিধান রয়েছে—বাংলাদেশ ব্যাংক এটা তুলে দেওয়ার পক্ষে ছিল। তবে আইনের সংশোধনী অনুমোদনের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক আর আপত্তির কথা জানায়নি বলে জানা গেছে।
১৯৯৬ সালের ব্যাংক সংস্কার কমিটির সুপারিশ ছিল, ‘একই পরিবারের একাধিক সদস্য পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে পারবেন না।’ তবে কখনোই এই সুপারিশ আমলে নেয়নি কোনো সরকার; বরং ২০১৩ সালে একই পরিবার থেকে দুই সদস্যকে পরিচালক হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। আর এবার তা বাড়িয়ে চারজন করা হলো।
বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক এখন অনেক ভালো করছে বলে ব্যাংক সূত্রগুলো জানায়। আবার কিছু ব্যাংকের অবস্থা সংকটাপন্ন। কিছু ব্যাংক অতীতে ভালো থাকলেও এখন খারাপ হয়ে গেছে। তবে সামগ্রিকভাবেই বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোতে সুশাসন হ্রাস পাচ্ছে, অনিয়ম বাড়ছে। পরিদর্শক বসিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এই অবস্থায় ব্যাংক কোম্পানি সংশোধন পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করবে বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, মালিকদের চাহিদামতো এই পরিবর্তন আসায় পুরো খাত কিছু পরিবারের হাতে জিম্মি হয়ে পড়বে। নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে। ব্যাংকের নীতিগত বিষয়ে মালিকদের প্রভাব আরও বাড়বে; যা পুরো খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের অন্তরায় হবে।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, মনোনীত বা নির্বাচিত পরিচালক নিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া আগের মতো পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিযুক্ত বা পদায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে। অন্যান্য নিয়মকানুন আগের মতোই রয়েছে। এই আইনের সংশোধনী দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকও এতে সম্মতি দিয়েছে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ পাস হওয়ার পর থেকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিচালকদের মেয়াদ-সম্পর্কিত ধারাটি পাঁচবার সংশোধন করা হয়েছে। এই ধারায় ব্যাংকের পর্ষদে একজন পরিচালক কত বছর পরিচালক থাকতে পারবেন, সে কথা বলা রয়েছে। সর্বশেষ ধারাটি সংশোধন করা হয় ২০১৩ সালে। এবারেরটি ষষ্ঠবারের মতো সংশোধন।