পৌরসভা নির্বাচন
ব্যবসায়ী বেশি ধানের শীষে, সম্পদশালী বেশি নৌকায়
হলফনামায় প্রার্থীরা যে সম্পদের বিবরণ দেন, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। হলফনামার ছকেও পরিবর্তন আনা দরকার।
দ্বিতীয় ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে একটি জায়গায় বেশ মিল। সেটি হলো পেশা। দুই দল থেকেই মনোনীত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ ব্যবসায়ী। তবে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপিতে ব্যবসায়ী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। বিএনপির প্রার্থীদের প্রায় ৮৭ শতাংশই পেশায় ব্যবসায়ী, আর আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে ব্যবসায়ী আছেন প্রায় ৭৩ শতাংশ।
পেশায় ব্যবসায়ী বেশি হলেও বিএনপির প্রার্থীদের আয় ও সম্পদ তুলনামূলক কম। প্রথম ধাপের মতো দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থীদের চেয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের আয় ও সম্পদ তুলনামূলক বেশি। অন্যদিকে এখন বেশি মামলা বিএনপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। ৭৬ শতাংশ প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা আছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে এখন মামলা আছে প্রায় ১৬ শতাংশের নামে।
#বিএনপির প্রার্থীদের ৮৭% ব্যবসায়ী।
# আ.লীগের ৭৩% ব্যবসায়ী।
# ২৮ জনের বার্ষিক আয় ৫ লাখের বেশি। তাঁদের ২০ জনই আ.লীগের।
# স্থাবর সম্পদ বাদ দিয়ে নগদ, সঞ্চয়সহ ১০ লাখ টাকার বেশি সম্পদ আছে ৩৭ জনের। তাঁদের মধ্যে ২২ জন আওয়ামী লীগের।
দ্বিতীয় ধাপে ১৬ জানুয়ারি ৬২টি পৌরসভায় ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এগুলোর মধ্যে ৪৫টি পৌরসভার মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর হলফনামা পাওয়া যায়নি।
দুই দলেই অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন প্রার্থী থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর পাস প্রার্থী আছেন। অবশ্য দুই দলেই প্রার্থীদের একটি বড় অংশ উচ্চশিক্ষিত। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে ২১ জন এবং বিএনপিরও ২১ জন স্নাতক/স্নাতকোত্তর পাস। সর্বোচ্চ উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন ২৯ জন। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে ১৫ জনের। কয়েকজন হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য উল্লেখ করেননি।
এর আগে গত ২৮ ডিসেম্বর প্রথম ধাপে ২৪টি পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সব পৌরসভায় প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করেও একই চিত্র পাওয়া গিয়েছিল। অবশ্য হলফনামায় প্রার্থীরা সম্পদ ও অন্যান্য তথ্যের যে বিবরণ দেন, সেগুলোর সত্যতা নিয়ে অনেকেরই সংশয় আছে। হলফনামায় দেওয়া তথ্যও যাচাই করে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
হলফনামায় প্রার্থীরা যে সম্পদের বিবরণ দেন, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। হলফনামার ছকেও পরিবর্তন আনা দরকার। এটি আরও বিস্তৃত করতে হবে। সে সঙ্গে হলফনামার তথ্য যাচাইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে হলফনামা দেওয়ার উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।
হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ৪৪ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩২ জন তাঁদের পেশা হিসেবে ব্যবসা উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন ব্যবসার পাশাপাশি কৃষিকেও পেশা দেখিয়েছেন। পেশা ‘রাজনীতি’ উল্লেখ করেছেন মাত্র একজন। তিনি সুনামগঞ্জ সদর পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী নাদের বখত। শৈলকুপার কাজী আশরাফুল আজম পেশা উল্লেখ করেছেন ‘মেয়র হিসেবে জনসেবা’। আর মাধবপুরের শ্রীধাম দাশ গুপ্ত পেশা উল্লেখ করেছেন সমাজসেবা। এ ছাড়া আছেন আইনজীবী, শিক্ষক, সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক।
অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে ৩৯ জনই পেশা উল্লেখ করেছেন ব্যবসা। তাঁদের মধ্যে নয়জন ব্যবসার পাশাপাশি কৃষির সঙ্গেও যুক্ত। এর বাইরে পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন আইনজীবী ও কৃষি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, হলফনামায় প্রার্থীরা যে সম্পদের বিবরণ দেন, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। হলফনামার ছকেও পরিবর্তন আনা দরকার। এটি আরও বিস্তৃত করতে হবে। সে সঙ্গে হলফনামার তথ্য যাচাইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে হলফনামা দেওয়ার উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। তিনি মনে করেন, হলফনামার তথ্যে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার একধরনের প্রতিফলন আছে।
আয় ও সম্পদ বেশি আ.লীগের প্রার্থীদের
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ৮৯ জন মেয়র পদপ্রার্থীর হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে ২৮ জনের বার্ষিক আয় ৫ লাখ টাকার বেশি। এর মধ্যে ২০ জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। আর বিএনপির ৫ জন প্রার্থীর বার্ষিক আয় ৫ লাখ টাকার ওপরে। স্থাবর সম্পদ বাদ দিয়ে নগদ, সঞ্চয়সহ ১০ লাখ টাকার বেশি সম্পদ আছে ৩৭ জন প্রার্থীর। তাঁদের মধ্যে ২২ জন আওয়ামী লীগের, আর ১৫ জন বিএনপির।
হলফনামায় উল্লেখ করা তথ্য অনুযায়ী, সম্পদশালী প্রার্থীদের একজন সিরাজগঞ্জ সদরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সৈয়দ আব্দুর রউফ। তিনি কোটিপতি হলেও তাঁর হাতে নগদ টাকা আছে মাত্র ৩৮ হাজার, আর ব্যাংকে আছে ২ লাখ টাকা। তাঁর ব্যবসার মূলধন আছে প্রায় ৯০ লাখ টাকার। তাঁর গাড়ির দাম প্রায় ১৮ লাখ টাকা। দুটি স্পিনিং মিলে তাঁর শেয়ার আছে। স্ত্রীর নামেও ব্যবসায় মূলধন আছে প্রায় ৩৪ লাখ টাকার। এ ছাড়া স্ত্রীর কাছে নগদ আছে ৫০ হাজার টাকা, তিনি একটি নির্মাণপ্রতিষ্ঠানের শেয়ারধারী। তাঁর স্বর্ণ আছে ৫৬ তোলা।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী বিল্লাল হোসেন সরকার। তাঁর প্রায় ৬৮ লাখ টাকার সম্পদ আছে। তাঁর হাতে নগদ টাকা আছে ৩১ লাখের বেশি। তিনি একটি ফিলিং স্টেশনের মালিক। মুন সিনেমা হলেরও ৫০ শতাংশ মালিকানা তাঁর। আছে মাছের ব্যবসা। বিল্লাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সিনেমা হলের ব্যবসা, ফিলিং স্টেশনের ব্যবসা আছে। আমার যা সম্পদ আছে, নির্বাচনের ক্ষেত্রে এগুলো কোনো প্রভাবই ফেলবে না।’
বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে অন্যতম ধনী প্রার্থী কিশোরগঞ্জের মো. ইসরাইল মিয়া। তাঁর হাতে নগদই আছে ১ কোটি টাকার বেশি। সঞ্চয় আছে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া তাঁর ১টি বাড়ি, ৬ শতাংশ অকৃষিজমি, স্ত্রীর ১০ ভরি স্বর্ণ আছে বলে তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। ইসরাইল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সম্পদ বেশি হলেও নির্বাচনে প্রচারের ক্ষেত্রে তা প্রভাব পড়বে না। তিনি আগে ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন। অনেক দিন ধরে সে ব্যবসা এখন চালাতে পারছেন না। জমানো সম্পদ ভেঙে এখন তিনি চলছেন।
মামলা বেশি বিএনপি প্রার্থীদের
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, বিএনপির ৪৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩৪ জনের নামেই এখন মামলা আছে। বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থীদের বিরুদ্ধে পাঁচটির বেশি মামলা আছে ১০ জনের বিরুদ্ধে। আর ১০টির বেশি মামলা আছে তিনজনের নামে।
সবচেয়ে বেশি মামলা সিরাজগঞ্জ পৌরসভায় বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী মো. সাইদুর রহমানের বিরুদ্ধে। তাঁর বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা বিচারাধীন। এই মামলাগুলোর বেশির ভাগ হয়েছে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে। সাইদুর রহমান দাবি করেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে, তার সবই রাজনৈতিক। আমাকে দাবায়ে রাখতে এই মামলাগুলো দিয়েছে। সবগুলো মামলাতেই আমি জামিনে আছি।’
১৮টি মামলা আছে সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়া পৌরসভার বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী মো. আজাদ হোসেনের নামে। এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে আরও তিনটি মামলা ছিল, সেগুলো থেকে খালাস পেয়েছেন। তাঁর দাবি, তাঁকে রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে মামলাগুলো করা হয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে রাজনৈতিক আন্দোলনের সময়ে এসব মামলা হয়।
আজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিস্ফোরক আইন, ভাঙচুর, আগুন দেওয়ার এসব মামলার কোনো প্রমাণ নেই। যখন আমি ঢাকায় থাকতাম, তখন মামলা করা হয়। কয়েকবার গ্রেপ্তার করার পরে মামলা দেওয়া হয়েছে। মামলা প্রমাণ করতে পারে না বলে তিনটি থেকে খালাস পেয়েছি।’
১৭টি মামলা চলমান আছে সাভারের বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী রেফাত উল্লাহর। এই মামলাগুলো বিস্ফোরক দ্রব্য ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনের। তিনি এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সবই রাজনৈতিক মামলা। থানায় ধরে নেওয়ার পর মামলা দেওয়া হয়।
বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে এখন ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা আছে। এ ছাড়া ৮ জনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল। সেগুলো থেকে তাঁরা খালাস পেয়েছেন বা মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তেমন একজন প্রার্থী নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল কাদের মির্জা। তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই। অতীতে তাঁর বিরুদ্ধে ১২টি মামলা ছিল। এগুলোর মধ্যে ৮টি মামলার সব আসামি খালাস পেয়েছেন, আর ৪টি মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।
আবদুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্য এসব মামলা দিয়েছিল। তাঁর ছোটখাটো ওষুধের ব্যবসা। সম্পদও তেমন নেই। যে ব্যবসা, সেটাও প্রায় নিবু নিবু। তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর সম্পদ নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তিনি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চান।