বেশি দিন গরম থাকে যশোরে

বাসের জানালার পাশের আসনে বসা তৃষ্ণার্ত শিশুটি কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পথে পানি বিক্রেতার দিকে। ঢাকার কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়েপ্রথম আলোর ফাইল ছবি

দেশে সবচেয়ে বেশি দিন গরম থাকে যশোরে। ৩৮ বছরের প্রবণতা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই জেলায় বছরে গড়ে ৭৫ দিন আবহাওয়া বেশি উষ্ণ ছিল, যা রাজশাহী (৬৭ দিন) ও ঈশ্বরদীর (৫৮ দিন) চেয়ে বেশি।

দেশের ৯টি জেলার ১৯৮০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এই তথ্য তুলে ধরেছেন পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য গবেষক আতিক আহসান। তাঁর গবেষণায় আরও উঠে আসে যে রাজশাহী ও যশোর দেশের ‘চরম আবহাওয়া’প্রবণ জেলা। রাজশাহীতে বছরে ১৫৫ দিন শীত অথবা গরম বেশি ছিল। যশোরে তা ১৫৩ দিন। এর পরে রয়েছে ঈশ্বরদী, ১৪৫ দিন।

ঢাকায় বছরে ৫২ দিন বেশি শীত ও ৩৬ দিন বেশি গরম ছিল। সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল কক্সবাজার। সেখানে মাত্র ৩২ দিন চরম আবহাওয়া ছিল।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বছরের যেসব দিনে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা থাকে, সেসব দিনকে চরম আবহাওয়ার তালিকায় রাখে। আর ১৫ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা থাকলে সেই দিনকেও রাখা হয় চরমের তালিকায়।

বৈশ্বিক জলবায়ু বদলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের খুব বেশি কিছু করার নেই। তবে আমরা যদি যশোর-খুলনার মতো উপকূলীয় এলাকায় নদীর পানি প্রবাহ বাড়াতে পারি, সেখানে বনভূমি রক্ষা ও গাছপালা বাড়াতে পারি, তাহলে বৃষ্টিপাত বেড়ে তাপমাত্রা কিছুটা হলেও কমানো যাবে। বিশেষ করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর গরমকালের কষ্ট কমবে
আশরাফ দেওয়ান, অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

আতিক আহসানের বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় গরম ও শীত বেশি থাকা দিনের সংখ্যা বাড়ছে। ৩ বছরের গড় হিসাবে ১৯৮২ সালে ৩১–৬০ দিন গরম বেশি থাকা ৬টি জেলার মধ্যে শীর্ষে ছিল যশোর। সেখানে গরম বেশি ছিল ৪৮ দিন। এরপর ছিল পাবনা (৪২ দিন), মৌলভীবাজার (৩৬ দিন) ও রাজশাহী (৩৪ দিন)। ৬০ দিনের বেশি ‘চরম’ গরমে ভুগতে হয়নি হিসাবে আসা একটি জেলার মানুষকেও। অবশ্য সব জেলার ক্ষেত্রে তখনকার তথ্য পাওয়া যায়নি।

২০১৭ সালে এসে ৩ বছরের গড় হিসাবে দেখা যাচ্ছে, রাজশাহী ও যশোরে বছরে গড়ে ৯০ দিনের বেশি চরম গরম ছিল। ৬০–৯০ দিন চরম গরম ছিল চুয়াডাঙ্গা, পাবনা, সাতক্ষীরা ও খুলনায়। ১৩টি জেলায় ৩১–৬০ দিন চরম গরম ছিল। এর মানে বেশি গরম থাকা জেলার সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যালগেরি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একদল গবেষকের প্রকাশ করা এক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের তুলনায় উপকূলীয় জেলাগুলোয় তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ছে। তাঁরা গরম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, মৌসুমি বায়ু ক্রমশ শুষ্ক হয়ে ওঠা, নদী-জলাশয় শুকিয়ে যাওয়া ও বনভূমি কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদদের মতে, দেশে মার্চ-এপ্রিলে গরম বাতাসের একটি প্রবাহ প্রবেশ করে। আগে এর মূল কেন্দ্রটি পাবনার ঈশ্বরদী এলাকা দিয়ে ঢুকে রাজশাহী বিভাগে বেশি দিন অবস্থান করত। সাম্প্রতিককালে তা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে যশোর-চুয়াডাঙ্গা দিয়ে দেশে প্রবেশ করছে। অধিদপ্তরের জলবায়ু গবেষক ও আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে উষ্ণ বায়ুপ্রবাহের প্রবেশের পথ কিছুটা বদলে যাচ্ছে।

পরিবেশ গবেষক আতিক আহসানের পর্যবেক্ষণ অবশ্য বলছে, শুধু আবহাওয়াগত কারণেই যশোর অঞ্চলের আবহাওয়া চরম হয়ে উঠছে, তা নয়। এর সঙ্গে নদী শুকিয়ে যাওয়া ও গাছপালা কমে যাওয়াও অন্যতম কারণ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যশোরের একটি অংশজুড়ে একসময় সুন্দরবন বিস্তৃত ছিল। নদী বেশি ছিল, পানিপ্রবাহ বেশি ছিল। এখন বন নেই, নদীতে পানিপ্রবাহ কমে গেছে।

২০১৭ সালে এসে ৩ বছরের গড় হিসাবে দেখা যাচ্ছে, রাজশাহী ও যশোরে বছরে গড়ে ৯০ দিনের বেশি চরম গরম ছিল। ৬০–৯০ দিন চরম গরম ছিল চুয়াডাঙ্গা, পাবনা, সাতক্ষীরা ও খুলনায়। ১৩টি জেলায় ৩১–৬০ দিন চরম গরম ছিল। এর মানে বেশি গরম থাকা জেলার সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে।

প্রথম আলোর যশোর প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য অনুযায়ী জেলাটির ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া সাতটি নদীর মধ্যে মাত্র দুটি এখনো কোনোমতে খরস্রোতা হয়ে টিকে আছে। ভৈরব ও মুক্তেশ্বরী নদ–নদী মৃতপ্রায়। কপোতাক্ষ, শ্রীহরী, টেকা, বুড়িভদ্রাসহ অন্যান্য নদ–নদীর পানিপ্রবাহ কমেছে।

আজ মঙ্গলবার জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব আবহাওয়া দিবস। ১৯৫০ সাল থেকে দিবসটি পালন করা হয়। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সাগর, আমাদের জলবায়ু ও আবহাওয়া’।

জানতে চাইলে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আশরাফ দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু বদলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের খুব বেশি কিছু করার নেই। তবে আমরা যদি যশোর-খুলনার মতো উপকূলীয় এলাকায় নদীর পানি প্রবাহ বাড়াতে পারি, সেখানে বনভূমি রক্ষা ও গাছপালা বাড়াতে পারি, তাহলে বৃষ্টিপাত বেড়ে তাপমাত্রা কিছুটা হলেও কমানো যাবে। বিশেষ করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর গরমকালের কষ্ট কমবে।’