বৃষ্টি পাত্তা পায়নি শরতের কাছে
সারা রাতই কমবেশি বৃষ্টি ছিল। ভোরেও ঝিরঝির বৃষ্টির দাপট। মৃদুমন্দ হাওয়া সারাক্ষণ। এর কোনো কিছুই পাত্তা পেল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় সমাগত শরৎ-বন্দনাকারীদের কাছে। তাঁরা এখানে বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রজন্মান্তরে বয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ নিলেন। বৃষ্টিভেজা উৎসবে মেতে সমাগত লোকজন শরৎসহ সব ঋতুবৈচিত্র্যের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগ নিয়ে বাঙালির মানসকাঠামোতে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
আজ ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজন করে শরৎ উৎসব। বিরূপ প্রকৃতির কারণে উৎসবের সফলতায় সন্দিহান থাকলেও শেষ পর্যন্ত উৎসবেরই জয় হয়েছে। সকাল ও বিকেল-দুই বেলায় বিভক্ত শরৎ উৎসবের আয়োজক প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরীর স্বস্তি, উদ্বোধকসহ পূর্বনির্ধারিত ২ জন অতিথি এবং ১ জন আবৃত্তিশিল্পী বাদে সবাই এসেছেন সকালের পর্বে। তাঁর আশা, বিকেলেও ভালো সাড়া মিলবে।
শনিবার সকাল, ছুটির দিনে ঢাকা শহরের ঘুম তখনো ভালো করে ভাঙেনি। সংগত কারণে পথও ছিল ফাঁকা। টিএসসিতে তারুণ্যের আড্ডা জমতে দেখা যায়নি। শরতের নৈসর্গিক রূপবন্দনাই ছিল উৎসবের সংগীতে, নৃত্যে। মঞ্চও সাজানো হয়েছিল মেঘ আর কাশফুলের ছবি দিয়ে। সব মিলিয়ে শরতের মতো উৎসবেও ছিল স্নিগ্ধ পরিবেশ।
সকাল সাড়ে সাতটায় শিল্পী নুরুল হকের সন্তুরে রাগ পরিবেশনায় শুরু হয় সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর শরৎ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। নির্ধারিত সময়েই অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান। তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতায় শরতের রূপটিই ফুটে উঠল। বর্ষা শেষে অপেক্ষা, কখন আসবে একটি সুন্দর সময়! এখন আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা-কালো মেঘ, কখনো আবার আবছায়া। প্রকৃতির এমন খেলায় শরতের আনন্দোৎসব এসে জানিয়ে গেল, আমাদের সামনের দিনগুলো আলোকময়, বললেন অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য বাঙালির মনে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনার জন্ম দিয়েছে’ বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমরা যে বলি, আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য; সেটির মধ্যে শরৎ একটি শক্তিশালী অনুষঙ্গ। মানুষের হৃদয়ের যে প্রশস্ততা শরৎ সেখানে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। মানস কাঠামোতে, জীবনাচারে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে আসে শরতের দুর্গোৎসব। শরৎ সেখানে অনেক গ্রহণীয়।’ এ সময় শরৎ উৎসবের তাৎপর্য নিয়ে কথা বলেন সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর নিগার চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট।
অনুষ্ঠানে একক সংগীত পর্বে মহাদেব ঘোষ গেয়ে শোনান রবীন্দ্রসংগীত 'অমল ধবল পালে'। পরে শিল্পী অনিমা রায় শোনান রবীন্দ্রসংগীত ‘আমার রাত পোহালো’ ও ‘দেখো দেখো সুখতারা’, সুমনা মজুমদার শোনান নজরুলসংগীত ‘ভোরের ঝিলের জলে শালুক পদ্ম তোলে’, সঞ্জয় কবিরাজ শোনান নজরুলসংগীত ‘শিউলি ফুল দোলে’, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস শোনান ‘ও আকাশ বল আমারে’। একক আবৃত্তি পর্বে নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলী শোনান কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাংলাদেশ-নম নম নম’। দলীয় নৃত্য পর্বে সালমা মুন্নির পরিচালনায় দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যাক্ষ। অনিক বসুর পরিচালনায় স্পন্দন, নাঈম হাসান সুজার পরিচালনায় নৃত্যজন, ফারহানা চৌধুরী বেবীর পরিচালনায় বাফা দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে।
দলীয় সংগীত পর্বে রবীন্দ্রসংগীত ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী শোনায় নজরুলসংগীত ‘আজি শারদ প্রাতে’, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী শোনায় ‘আজও আছে একতারা আর নকশি কাঁথার মাঠ’, বহ্নিশিখা শোনায় ‘বিশ্ব সাথে জেগে যেথায় বিহারো’।
শনিবার সকালের এই আয়োজনে নৃত্য, গান, কবিতার পরিশীলিত পরিবেশনে শিল্পীরা যেমন শরৎকে বরণ করেছেন, ঠিক তেমনি উৎসবপ্রিয় দর্শকদের আন্তরিক অভিবাদনেও উঠে এসেছে শরতের প্রতি তাঁদের ভালো লাগা আর ভালোবাসার প্রকাশ।