একাত্তরে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের যে বর্বরভাবে হত্যা করা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোনো সাজা ওই বর্বরতার বিচারে অক্ষম। একমাত্র ও একমাত্র সর্বোচ্চ শাস্তিই গোটা জাতি এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে পারে।
একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের আগমুহূর্তে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অন্যতম দুই হোতা, গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণাকালে এ কথা বলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। একাত্তরের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে তাঁদের দুজনকেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তাঁদের বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ। গতকাল রোববার এ রায় ঘোষণা করা হয়।
স্বাধীনতার চার দশক পর প্রথমবারের মতো বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার হলেও রায় ঘোষণার সময় এজলাসে আসামির কাঠগড়া ছিল শূন্য। কারণ, স্বাধীনতার পরপরই মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান বিদেশে পালিয়ে যান। এ জন্য পলাতক ঘোষণা করে তাঁদের অনুপস্থিতিতেই বিচার হয়েছে। বর্তমানে মুঈনুদ্দীন থাকেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে, আশরাফুজ্জামান থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেন। এ সময় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের কয়েকজন সদস্য ও এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের কয়েকজন সাক্ষী এজলাসে উপস্থিত ছিলেন।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, জামায়াতে ইসলামীর মস্তিষ্কপ্রসূত ঘাতক বাহিনী আলবদর একাত্তরে বুদ্ধিজীবী নিধনের যে নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে, তা গোটা জাতির বুকে ক্ষত হয়ে আজও রক্ত ঝরাচ্ছে। আমরা আরও বিশ্বাস করি, গত চার দশকে মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যাকারীদের বিচার করতে না পারায় জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত; এ লজ্জা আমাদের ক্ষতকে দিন দিন বাড়িয়ে তুলেছে। বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ বাঙালি জাতিকে চিরদিন নিদারুণ যন্ত্রণাই দিয়ে যাবে।’
বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে রায়ে বলা হয়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের হিংস্রতা মৌলিক মানবতাবোধের জন্য হুমকি। ইতিহাস বলে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে নানা ধরনের নৃশংস আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি, যেখানে জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্য করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞ শুধু অপরাধীর অপরাধের মাত্রাই বাড়ায়নি, গোটা জাতির জন্য যন্ত্রণার ছাপ এঁকে দিয়েছে। দশকের পর দশক ধরে জাতি ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যরা সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকে চেপে আছেন, আইনের অক্ষর এখানে নির্বিকারভাবে বসে থাকতে পারে না। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে অপরাধের গভীরতার বিচারে একমাত্র মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে ন্যায়বিচার করা হবে।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও দালিলিক তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন আলবদর বাহিনীর একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন। আশরাফুজ্জামান ছিলেন বুদ্ধিজীবী নিধন পরিকল্পনার ‘চিফ এক্সিকিউটর’, মুঈনুদ্দীন ছিলেন ‘অপারেশন ইনচার্জ’। তাঁদের অংশগ্রহণে যেমন বন্দুকের নলের মুখে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে হত্যা করা হয়েছে, তেমনি পুরো হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিষয়ে তাঁরা সবকিছু জানতেন। এ জন্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য তাঁদের ব্যক্তিগত অংশগ্রহণের দায় ও ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ নিয়ে নয়টি মামলার রায় দিলেন। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-২ দিয়েছেন ছয়টি রায়, ট্রাইব্যুনাল-১ দিয়েছেন তিনটির রায়। এ নিয়ে দ্বিতীয় কোনো মামলায় আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার করা হলো। মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলার রায় হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে। তিনিও পালিয়ে যাওয়ায় তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচার হয়েছিল।
মুঈনুদ্দীন-আশরাফের হত্যাযজ্ঞের শিকার ১৮ বুদ্ধিজীবী: মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলায় একাত্তরে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল ১১টি অভিযোগে, যার সব কটি প্রমাণিত হয়েছে। যে বুদ্ধিজীবীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তাঁরা হলেন: দৈনিক ইত্তেফাক-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, পিপিআইয়ের (পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল) প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশ-এর প্রধান প্রতিবেদক এ এন এম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ, শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীন, দৈনিক সংবাদ-এর যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, ড. মো. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজির অধ্যাপক ফজলে রাব্বী ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরী। একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাত থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বুদ্ধিজীবীদের অপহরণের পর হত্যা করা হয়। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের মরদেহ পরে রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া গেছে, কয়েকজনের মরদেহের খোঁজ মেলেনি।
রায়ে বুদ্ধিজীবী নিধনের বিবরণ: ১৫৪ পৃষ্ঠায় ৪৫৩ অনুচ্ছেদে বিস্তৃত পূর্ণাঙ্গ রায়ে একাত্তরে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের প্রামাণ্য বিবরণ উঠে এসেছে। সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও দালিলিক তথ্যপ্রমাণ মূল্যায়ন করে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, চূড়ান্ত বিজয়ের আগমুহূর্তে সুপরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার বুদ্ধিজীবীদের তাঁদের বাসা থেকে অপহরণ করে জামায়াতের সশস্ত্র শাখা গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবী নিধনের নেতৃত্ব দেওয়া মুঈনুদ্দীন একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এ জন্যই অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে অপহরণের সময় তিনি মুঈনুদ্দীনকে চিনতে পেরেছিলেন। সাক্ষ্যপ্রমাণে উঠে এসেছে, বুদ্ধিজীবী নিধনের ‘অপারেশন ইনচার্জ’ হিসেবে মুঈনুদ্দীন শুধু নিধনে নেতৃত্বই দেননি, নিজেও অংশ নিয়েছেন। বন্দুকের নলের মুখে বাসা থেকে অপহরণ করে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে যাওয়া হতো মোহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা কলেজে স্থাপিত আলবদরের সদর দপ্তরে, সেখানে তাঁদের চরম নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো রায়েরবাজার বা মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে।
রায়ে বলা হয়, বিজয়ের পর আশরাফুজ্জামানের একটি ডায়েরি পাওয়া যায়, যা তাঁদের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অন্যতম প্রমাণ। ডায়েরিটিতে ১৯ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল। পাকিস্তানি গবেষক সেলিম মনসুর খালিদের লেখা আলবদর গ্রন্থ অনুসারে, ওই বইয়ের লেখকের কাছে আশরাফুজ্জামান ডায়েরি লেখার বিষয়টি স্বীকারও করেছেন।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রত্যেক বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ ও হত্যার সঙ্গে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও দালিলিক নথির ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ডা. আলীম চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ বিশ্লেষণ করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আলীম চৌধুরীকে অপহরণের সঙ্গে মাওলানা আবদুল মান্নান জড়িত ছিলেন। একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর মান্নানকে রমনা থানায় সোপর্দ করা হলেও পরে অজ্ঞাত কারণে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। জাতির জন্য লজ্জা, মাওলানা মান্নান পরে স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হন!
রায়ে বলা হয়, কেন বিজয়ের অব্যবহিত পরে মুঈনুদ্দীন পালিয়ে গেলেন এবং আজও বিদেশে রয়েছেন? সম্প্রতি আল-জাজিরা টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুঈনুদ্দীন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ ও অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। একজন অপরাধী সাধারণত তাঁর অপরাধ স্বীকার করেন না। স্বাধীনতার পরপরই তাঁর পালিয়ে যাওয়া অপরাধী মানসিকতার স্পষ্ট উদাহরণ। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মুসলিম এইডের সাবেক ট্রাস্টি মুঈনুদ্দীন বর্তমানে লন্ডনের টটেনহামে থাকেন। তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের মুসলিম স্পিরিচুয়াল কেয়ার প্রভিশনের পরিচালক। আশরাফুজ্জামান থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জ্যামাইকায়। তিনি সেখানে ইসলামিক সার্কেল অব নর্থ আমেরিকার (আইসিএনএ) শুরা সদস্য এবং স্থানীয় মসজিদের ইমাম।
প্রতিক্রিয়া: রায়ের পর আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে যান। তাঁরা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তাঁদের বিদেশ থেকে আইনসংগতভাবে ফিরিয়ে আনতে সরকার চেষ্টা করবে। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় তাঁদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হবে।
রায়ের পর ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের সমন্বয়ক এম কে রহমান বলেন, ‘আমরা রায়ে সন্তুষ্ট। এই দুই আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হবে।’
মামলার দুই তদন্ত কর্মকর্তা শাহজাহান কবীর ও আতাউর রহমান রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের তদন্ত বৃথা যায়নি।’
আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবদুস শুকুর খান ও সালমা হাই বলেন, ‘আমরা আসামিদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাইনি। তার পরও নিজেরাই বেশ কয়েকটি নথি জোগাড় করে তাঁদের নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করেছি। আসামিরা আত্মসমর্পণ করে আপিল করলে সাজা থেকে খালাস পেতে পারেন।’