সীতাকুণ্ডে আগুন-বিস্ফোরণ
বিস্ফোরণে হতভম্ব, দেড় ঘণ্টা ‘বন্ধ ছিল’ অগ্নিনির্বাপণ
৬১ ঘণ্টা পর গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মৃতের সংখ্যা বেড়ে হলো ৪৩।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে গত শনিবার রাতে আগুন নেভাতে যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের প্রথম দুটি দলের প্রায় সবাই আক্রান্ত হন প্রথম দফা বিস্ফোরণে। বিএম ডিপোর যেসব কর্মী সেখানে আগুন নেভানোর কাজ করছিলেন, তাঁদের অনেকেও মারাত্মকভাবে আহত হন। বাকিরা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। কেউ কেউ দৌড়ে বাইরে বের হয়ে বাঁচার চেষ্টায় ছিলেন। এর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আগুন।
বিস্ফোরণের আধা ঘণ্টার মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের পরবর্তী ইউনিট এলেও প্রথম দিকে তাদের সময় চলে যায় আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে। বিস্ফোরণ ভয় ধরিয়ে দেয় পরে যোগ দেওয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদেরও। মাঝে প্রায় দেড় ঘণ্টা অগ্নিনির্বাপণ কার্যক্রম বন্ধ থাকে।
ফায়ার সার্ভিস, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তারা আরও জানিয়েছে, বিস্ফোরণের পরপর আহত ফায়ার সার্ভিসের কর্মী, পুলিশ সদস্য ও ডিপোর শ্রমিক-কর্মচারী-চালকদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন স্থানীয় লোকজন। এরই মধ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন ইউনিট আসতে শুরু করে। পরবর্তী দলে আসা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পরিস্থিতি বুঝে আগুন নেভানোয় মনোযোগী হন।
সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনার ৬১ ঘণ্টা পর গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানানো হয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে। এরপর বেলা দুইটার দিকে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রামের উপপরিচালক আনিসুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে বলে জানিয়ে দেন। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আরও দুজনের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৪৩ জনে।
ফায়ার সার্ভিসের কুমিল্লার সহকারী পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘দুটি লাশ একেবারে পুড়ে গেছে। তবে পোশাক দেখে মনে হচ্ছে একজন আমাদের কর্মী, অপরজন নিরাপত্তাকর্মী। এ নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১০ জন নিহত হলেন। নিখোঁজ রয়েছেন দুজন।’
বিস্ফোরণের পর অগ্নিনির্বাপণ
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, শনিবার রাত সোয়া নয়টার দিকে আগুন লাগার আধা ঘণ্টার মধ্যেই প্রথমে কুমিরা ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা আগুন নেভাতে যান। পরপরই সীতাকুণ্ডের আরেকটি দল অংশ নেয়। বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে রাত পৌনে ১১টায়। এতে ঘটনাস্থলে আগুন নেভাতে থাকা ফায়ার সার্ভিসের দুই ইউনিটের লোকজন হতাহত হন বেশি। তাঁদের দুটি গাড়িও অনেকটা পুড়ে যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর গতকাল গাড়ি দুটি উদ্ধার করা হয়।
ঘটনাস্থলের পাশের কদমরসুল গ্রামের বাসিন্দা ওমর ফারুক বিস্ফোরণের ১০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছান বলে দাবি করে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হতাহত হন। তাঁদের উদ্ধারেও কেউ ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের দুজন কর্মী ও একজন পুলিশকে তিনি উদ্ধার করে বাইরে নিয়ে আসেন। সবাই বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিলেন। পানি চাইছিলেন। এ সময় কয়েকটি কনটেইনারে আগুন জ্বলছিল।
ওমর ফারুক ও ঘটনাস্থলের আশপাশের কয়েকজন দোকানি এবং ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানান, বিস্ফোরণের আধা ঘণ্টা পর নতুন করে সীতাকুণ্ড ও কুমিরা থেকে ফায়ার সার্ভিসের দুটি গাড়ি সেখানে যায়। তাঁরা পরিস্থিত পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তখন রাত সোয়া ১১টার মতো হবে। এরপর চট্টগ্রাম, ফেনীসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। তারা প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আগুন নেভানোর কাজ আবার শুরু করে।
বিস্ফোরণের পর দেড় ঘণ্টা নির্বাপণ বন্ধ থাকার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রামের উপপরিচালক আনিসুর রহমান গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘মালিকপক্ষ আমাদের বলেনি সেখানে রাসায়নিক রয়েছে। তাই বিস্ফোরণের পর কর্মীরা স্বাভাবিকভাবে কিছুটা ভয় পায় প্রথমে। এরপর অন্যান্য গাড়ি এসে যোগ দেয়। তবে আগুন নির্বাপণের চেষ্টা সব সময় ছিল।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, বিস্ফোরণের কারণে কনটেইনারের একটি বড় অংশ উড়ে এসে পড়ে ডিপোর প্রধান ফটকের কাছাকাছি। এ সময় অনেকের গায়ে আগুন লাগে। আর সবার চোখ জ্বলছিল। দাউ দাউ করে ওই কনটেইনারসহ কয়েকটি কনটেইনার জ্বলছিল। বিস্ফোরণের পর আসা ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো প্রথমে ফটকে কনটেইনারটির আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। এরপর ভেতরে ঢোকে।
ফায়ার সার্ভিসের ফেনী স্টেশনের উপসহকারী পরিচালক পূর্ণচন্দ্র মুৎসুদ্দী গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছান। এ সময় আগুন জ্বলছিল চারদিকে। আর মানুষের চিৎকার। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও ভয় পেয়ে যান ঘটনার আকস্মিকতায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের চট্টগ্রামের চন্দনপুরা ও আগ্রাবাদসহ অনেক ইউনিট তখন ঘটনাস্থলে ছিল। পরপর বিস্ফোরণ হচ্ছিল।’
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, শনিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে পুনরায় আগুন নেভানোর কাজ শুরু হলেও রাসায়নিক থাকা কনটেইনারের অগ্নিনির্বাপণের কাজ শুরু হয় ঢাকার বিশেষজ্ঞ দল আসার পর। রোববার দুপুরে ঢাকা থেকে ‘হেজম্যাট’ নামে রাসায়নিক অগ্নিনির্বাপণ দলটি ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
১৫টি কনটেইনার বিস্ফোরিত
ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রামের উপপরিচালক আনিসুর রহমান গতকাল দুপুরে বিএম ডিপোর ফটকে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ডিপোটিতে ২৮টি কনটেইনারে রাসায়নিক ছিল। এর মধ্যে ১৫ কনটেইনার বিস্ফোরিত হয়। বাকিগুলো এখনো ডিপোতে রয়েছে। সেগুলো ডিপোর মধ্যে নিরাপদ দূরত্বে রাখার জন্য বলা হয়েছে। তিনি জানান, রোববার পর্যন্ত ডিপোতে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট কাজ করেছে।
নিখোঁজদের খোঁজ চলছে
বিস্ফোরণে হতাহতের সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরে গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান জানান, নিহত ব্যক্তিদের ২৬ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। তাঁদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। বর্তমানে হাসপাতালটিতে ভর্তি আছেন ৬৩ জন। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আছেন দুজন।
শামীম আহসান আরও জানান, চট্টগ্রামের জেনারেল হাসপাতালে একজন, পার্কভিউ হাসপাতালে ১২ জন ও চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি আছেন ১৪ জন। হাসপাতালে লাশ আছে ১৭টি।
এদিকে গত দুই দিনে ২৩টি মরদেহের জন্য ৪০ জন স্বজন নমুনা দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ছিলেন পাঁচজন। আর বাকিরা ডিপোর কর্মচারী, নিরাপত্তাকর্মী ও শ্রমিক ছিলেন। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের দুজন সদস্যের মরদেহের পরিচয় বিভিন্নভাবে শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বিস্ফোরণের ঘটনায় গঠিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের তদন্ত কমিটি গতকাল বিকেলে ডিপো পরিদর্শন করে। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে তাঁরা ডিপোতে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতি দেখেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন। এ ছাড়া নগর পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলও গতকাল আলামত সংগ্রহ করেছে ঘটনাস্থল থেকে।