বিমানবন্দরে স্ক্যানের পরও ‘অধরা’ মাদক ভর্তি কার্টনগুলো
বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে মাদক পাচারকারী বেশ কটি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রথমে মাদক তৈরির কাঁচামাল সিডোঅ্যাফিড্রিন পাচার এবং পরে অ্যাম্ফিটামিন ও ইয়াবার চালান আটকের পর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেরাই বলছে এসব কথা।
পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, শাহজালাল বিমানবন্দর মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে, এমন তথ্য তারা পাচ্ছে। এর জন্য মূলত দায়ি লাগেজে পণ্য পরিবহনের সময় স্ক্যানিং ঠিকমতো না হওয়া।
মাদকের গন্তব্য প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। গত বছরের নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত পাচারের ঘটনায় তিনটি চক্রকে শনাক্ত করা হয়েছে। এসব চক্রে ৫০ থেকে ৬০ জন আছেন। নজরদারিতে রাখা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সাবেক একজন সাংসদ, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কর্মী, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতীয় পাসপোর্টধারী নাগরিক, নামসর্বস্ব ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, মিটফোর্ডকেন্দ্রিক ও ভারতীয় কয়েকজন ওষুধবিক্রেতাকে। এ পর্যন্ত তিনটি মামলায় বিমানবন্দরের কর্মকর্তা–কর্মচারীসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২১ জনকে। সম্প্রতি বিমানবন্দর থানা মাদক পাচারে সম্পৃক্ততার অভিযোগে স্ক্যানিং সুপারভাইজার রবিউল আলম ও অপারেটর এস এম ওমর ফারুককে গ্রেপ্তার করেছে।
গত বছরের নভেম্বরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মালয়েশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে সিডোঅ্যাফিড্রিন পাঠানো হচ্ছিল। চালানটি মালয়েশিয়ায় ধরা পড়ে যায়। অপর দুটি চালানের একটি হংকং হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাম্ফিটামিন যাচ্ছিল। ইয়াবা যাচ্ছিল সৌদি আরবে। সব কটিই তৈরি পোশাক রপ্তানির ঘোষণা দিয়ে মাদক পাচারের চেষ্টা করে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, তাদের ধারণা, এখন পর্যন্ত পাচার হয়েছে ৬০০ কেজির মতো মাদক ও মাদক তৈরির উপকরণ। শুধু যে পাচার হয়েছে, তা–ই নয়। মাদক লাগেজে করে বিমানবন্দর হয়ে দেশের ভেতরেও ঢুকেছে।
সুরক্ষা সেবাসচিব মো. শহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেছেন, বিমানবন্দরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কোনো স্ক্যানিং মেশিন নেই। মাদক পাচার রোধে অধিদপ্তর এখন পৃথক একটি স্ক্যানিং মেশিন বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা ছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আহসানুল জব্বার জানিয়েছেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে অধিদপ্তর ডগ স্কোয়াডও চেয়েছে।
কার্গো স্ক্যানিংয়ে ধরা পড়েনি সিডোঅ্যাফিড্রিন
বিমানবন্দরের কার্গো স্ক্যানিংয়ের কাজ এককভাবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষই করে থাকে।
সিডোঅ্যাফিড্রিনের চালান মালয়েশিয়ায় ধরা পড়ার এক মাস পর বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। মামলার বাদী আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) মো. হেলাল। তদন্ত কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মাহবুব হোসাইন। আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে মাহবুব হোসাইন লেখেন, গত বছরের ৯ নভেম্বর মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসে ২৭ কার্টন মালামাল ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পাঠানো হচ্ছিল। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে চালানটি পরীক্ষা করে নার্কটিকস পাওয়া যায়। ২৭টির মধ্যে যে ১০টি কার্টনে নিষিদ্ধ সিডোঅ্যাফিড্রিন ড্রাগ ছিল, তা কার্গো ভিলেজের ৪ নম্বর স্ক্যানিং মেশিন দিয়ে স্ক্যানিং করে বিদেশে পাচার করা হয়। এই মামলার এজাহারনামীয় গ্রেপ্তার আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ঘটনার দিন সকালে কার্টনগুলো কাভার্ড ভ্যানে করে বিমানবন্দরের ভেতরে ঢোকে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন সদস্য নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলন, পাচারের সময় ৪ নম্বর স্ক্যানিং মেশিনের দায়িত্বে ছিলেন একজন নারী কর্মকর্তা। চালানটি পাচারের চেষ্টা করেছিলেন অস্ট্রেলীয় পাসপোর্টধারী তিন ব্যক্তি। তাঁরা এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আছেন। এর আগেও তাঁরা মাদক পাচার করেছেন। প্রতিবারই চালান পাঠানোর সময় তাঁরা বাংলাদেশে অবস্থান করেন। কল্যাণপুরের একটি নামসর্বস্ব ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এই সিডোঅ্যাফিড্রিনের জোগান দিয়েছিল।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তৌহিদ-উল-আহসান অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, কার্গো (পণ্য পরিবহনকারী) স্ক্যানিংয়ের দায়িত্ব বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের। তারপরও সন্দেহজনক কোনো ঘটনা ঘটলে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ অন্য সংস্থাগুলোকে সহযোগিতা করে থাকে। বিমানবন্দরের কার্গো স্ক্যানিং পার হয়ে একটি চালান বিদেশে চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু দুটি চালান অ্যাভিয়েশন সিকিউরিটির হাতেই ধরা পড়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, বেশ কটি চক্র মাদক পাচারে সক্রিয়।
জুনায়েদ–সীতেশ সক্রিয় ২০১৮ থেকে
গত ৯ সেপ্টেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে অ্যাভিয়েশন সিকিউরিটির সদস্যরা ইয়াবা তৈরির উপকরণ অ্যাম্ফিটামিন উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. হোসেন মিঞা। তিনি জানান, তৈরি পোশাক পণ্যের আড়ালে ১২ কেজি ৩২০ গ্রাম সাদা রঙের অ্যাম্ফিটামিন পাচারের চেষ্টা করেছিল পাচারকারীরা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মামলার তদন্ত করছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পরিদর্শক ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই মামলায় ১৩ জন গ্রেপ্তার আছেন।
মামলাটির তদারক করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাচারকারীরা বাংলাদেশি ও ভারতীয়। তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক জুনায়েদ জানিয়েছেন, তিনি একসময় আবুধাবিতে শ্বশুরের আবাসন ব্যবসার দেখাশোনা করতেন। সেখানেই চেন্নাইভিত্তিক ব্যবসায়ী সীতেশের সঙ্গে পরিচয় হয়। ২০১৮ সালের দিকে তিনি ও সীতেশ অ্যাম্ফিটামিন পাচার শুরু করেন। তাঁরা মিটফোর্ডে বান্টি নামের এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে কলকাতা থেকে নিয়মিত সিডোঅ্যাফিড্রিন, অ্যাম্ফিটামিন আনতে থাকেন। উত্তরায় নেপচুন ফ্রেইট নামে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিংয়ের একটি অফিস নেন দুজন। মাদকের প্যাকেজিং সীতেশের তত্ত্বাবধানে হতো। সবশেষ যে চালানটি ধরা পড়ে, সে সময় সীতেশ ঢাকায় ছিলেন না।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মোসাদ্দেক হোসেন প্রথম আলোকে এক প্রশ্নের জবাবে জানান, সীতেশের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বাংলাদেশ।