দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জাতিসংঘসহ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানালেও সরকার এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে নীরব। ভারত ছাড়া প্রায় সব দেশই এই একতরফা নির্বাচন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে। সংলাপে বসে সমঝোতার মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করারও তাগিদ দিয়েছে তারা।
ভোট গ্রহণের আগেই অর্ধেকের বেশি প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া, ভোটারের উপস্থিতি কম থাকা এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে হতাশ করেছে। ৫ জানুয়ারির পর গত কয়েক দিনে জাতিসংঘ ছাড়াও দুই আন্তর্জাতিক সংগঠন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও কমনওয়েলথ, গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং এশিয়ান হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বক্তব্য-বিবৃতিতে এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এরা কেউ নতুন সংসদকে স্বাগত জানায়নি।
প্রতিবেশী ভারত এ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। তবে সমর্থনসূচক মনোভাব প্রকাশ করে দেশটি বলেছে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল আবশ্যক। সর্বশেষ গতকাল মার্কিন সিনেট বাংলাদেশ বিষয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র বলেছে, বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোর বক্তব্য-বিবৃতি তারা পর্যবেক্ষণ করছে। নতুন সরকার গঠনের আগে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেওয়া হবে না। কাল রোববার মন্ত্রিসভা গঠনের পর আগামী সপ্তাহে বিদেশি কূটনীতিকদের সরকারের অবস্থান অবহিত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোর পরামর্শ খুবই যৌক্তিক ও অর্থবহ। যত দ্রুত সম্ভব সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার গঠিত হলে শুধু বর্তমান সরকারই নয়, বিরোধী দল তথা বাংলাদেশ এবং জনগণ উপকৃত হবে।
মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, জাতিসংঘসহ বিদেশি রাষ্ট্রগুলো এখনই সংলাপ শুরু করে সমঝোতার মাধ্যমে আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে তাগিদ দিচ্ছে, সরকার সে বিষয়টিকে এখন ততটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। নতুন নির্বাচনের ব্যাপারে সরকার তাড়াহুড়া করতে চায় না। তবে বিরোধী দল চাইলে সরকার আলোচনা শুরু করতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে অবশ্যই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ছেড়ে আসতে হবে।
তবে সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের এই অবস্থানের কথা ইতিমধ্যে বিদেশি কূটনীতিকদের অনানুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, নির্বাচন নিয়ে হতাশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজের অবস্থান তুলে ধরার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর ইইউর কাছে একটি প্রতিনিধিদল পাঠানোর চিন্তা রয়েছে। নির্বাচনের পরপরই এই প্রতিনিধিদলের ইইউ সদর দপ্তরে যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তিনি বিরোধী দলকে সন্ত্রাস ও সহিংসতা পরিহার করে এবং যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গিবাদী জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে আলোচনায় আসতে বলেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিদেশি রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোর কাছে এ বিষয়টি তুলে ধরা হবে।
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর আরও বলেন, এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সরকার যে স্বস্তিতে আছে, এমনটি নয়। নির্বাচনের আগে ও পরে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে কয়েকজন মন্ত্রী একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে সংলাপের কথা বলেছেন। এতে বোঝা যায়, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার ঘাটতি নিয়ে সরকার সজাগ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সমালোচনা: আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের নির্বাচনে সহিংসতা, প্রধান বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন করা এবং ভোটার কম থাকার বিষয়গুলো উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিবিসির খবরের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘সহিংসতা ও বর্জনের মধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচন’। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট-এর খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধীদের বর্জন নির্বাচনের বৈধতাকে ক্ষুণ্ন করেছে। দেশটির আরেক প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস-এর শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশে বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন’। রয়টার্স শিরোনাম করে, ‘বাংলাদেশের সহিংসতা ও বর্জনের নির্বাচনে জয়ের পথে ক্ষমতাসীন দল’।
ভারতের বেশির ভাগ গণমাধ্যম বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে সে দেশের সরকারের অবস্থানের সঙ্গে মিল রেখে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। তবে কিছু গণমাধ্যম নির্বাচনের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরছে। নির্বাচন নিয়ে ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া শিরোনাম করে, ‘বাংলাদেশে রক্তক্ষয়ী নির্বাচনে ১২ জন নিহত, ২০০ কেন্দ্রে বোমা হামলা’। এনডিটিভির খবরের শিরোনাম ছিল, ‘বিরোধীদের বর্জনে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম’।
সংলাপের আহ্বান জাতিসংঘের: জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন প্রধান দুই দলকে আবার আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। নির্বাচনের পর জাতিসংঘ সদর দপ্তরে মহাসচিবের মুখপাত্র বলেন, ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক শান্তিপূর্ণ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজনে দলগুলো সমঝোতায় পৌঁছতে সক্ষম না হওয়ায় বান কি মুন দুঃখিত। কম ভোটারের অংশগ্রহণে দশম সাধারণ নির্বাচনে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় তিনি মর্মাহত।
ইইউ সব দলকে সহিংসতা পরিহার করে স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নতুন নির্বাচনের জন্য প্রকৃত সংলাপ শুরুর আহ্বান জানিয়েছে।
এ নির্বাচন নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এতে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার বিশ্বাসযোগ্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি।
যুক্তরাজ্য বলেছে, নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণ কম হওয়ার বিষয়টি হতাশাজনক। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতো যুক্তরাজ্যও বিশ্বাস করে, পরিণত ও কার্যকর গণতন্ত্রের প্রকৃত স্মারক হচ্ছে শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। চীন উদ্বেগ জানিয়ে আশা প্রকাশ করে বলেছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো দীর্ঘ মেয়াদে জাতীয় ও মৌলিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে।
ভারতের কৌশলী অবস্থান: নির্বাচনের এক দিন পর ভারত বলেছে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল আবশ্যক। এই নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার অংশ।
প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ভারতের মত, নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে সাংবিধানিক সংকট হতো। তবে তারা এ-ও মনে করে, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ থাকলে তা ভালো হতো। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে নির্বাচন হবে—ভারতের এমন আশাবাদ থাকলেও কবে ওই নির্বাচন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে কোনো মত এখনো প্রকাশ করেনি ভারত।
বিদেশিরা নির্বাচনের আগে থেকেই সমঝোতার কথা বলে আসছে, সরকার বা বিরোধী দল তো শুনছে না—এ বিষয়ে সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুরোধ বা পরামর্শ না শুনলে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরতে পারে। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতায় জন্ম নেওয়া অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এতে চলমান সংকট বাড়তেই থাকবে।