‘বিকট শব্দে কানে তালা লাইগা গেল, উইঠা দেখি, গায়ে রক্ত’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের একটি শয্যায় শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন রজ্জব আলী (৪০)। বাঁ হাত আর পুরো বুক ব্যান্ডেজে মোড়ানো। ঘটনার পর থেকে খুলতে পারছেন না চোখও। ওই অবস্থায় হঠাৎ কথা বলে উঠলেন তিনি। বললেন, ‘ভাই কেয়ামত হইসে কাইল রাইতে।’
রজ্জবের বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ভাতিজা মো. আমিন। কথা শুরু করেছিলাম তাঁর সঙ্গেই। মধ্যে রজ্জব এইভাবে কথা বলে ওঠায় চমকে গেলাম আমরা দুজনেই। আমিনের কাছ থেকে জানা গিয়েছিল, গাড়ি নিয়ে ডিপোতে গিয়েছিলেন তাঁর চাচা। আমিন নিজেও লরি চালান। শনিবার রাতে ভয়াবহ এই বিস্ফোরণের সময় তিনিও ছিলেন সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর কাছাকাছি। বিস্ফোরণে চাচা আহত হয়েছেন শুনে আমিন নিজে গিয়ে উদ্ধার করে তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেন। এরপর হাসপাতালেও চাচার পাশে আছেন।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুনঃ
ছুটি শেষে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার রাতেই প্রাণ গেল আলাউদ্দিনের
‘পুড়ে যাচ্ছি, মরে যাচ্ছি’ বলতে বলতেই মারা গেলেন মহিউদ্দিন
ভিডিও কলে কথা বলতে বলতে বিস্ফোরণ, সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সোবহানের
ডিপোতে দাঁড়িয়ে করছিলেন ফেসবুক লাইভ, হঠাৎ বিস্ফোরণে গেল প্রাণ
রজ্জবকে কথা বলতে শুনে এগিয়ে গিয়ে তাঁর কাছে দাঁড়াই। জানতে চাই কী ঘটেছিল কাল, কী করে আহত হলেন তিনি? বন্ধ চোখে রজ্জব যেন আমাকে দেখছিলেন। শোয়া থেকে মুখটা একটু তুলে বললেন, ‘ধরেন, রাইত নয়টা থেইকা আগুন লাগসে। আমি ডিপোর শেডের কাছাকাছি দাঁড়াই সব দেখতে ছিলাম। ফায়ার সার্ভিসে পানি মারতাসে। হঠাৎ বুম কইরা বিকট শব্দে কানে তালা লাইগা গেল। কতক্ষণ পর উইঠা দেখি, গায়ে রক্ত। শেডের ছাদ ধইসা গেছে, জানালা চুরমার। আমি আস্তে আস্তে হাঁটার চেষ্টা করলাম। তারপর আর কিছু মনে নাই।’
শয্যায় কাতরাতে থাকা রজ্জবকে তবু সৌভাগ্যবানই মনে হয়। অনন্ত তিনি এ যাত্রায় বেঁচে যাবেন বলেই মনে হয়। অন্তত জরুরি বিভাগের ১৭ নম্বর কক্ষে তাঁকে যেতে হয়নি। দুই ঘণ্টা আগে জরুরি বিভাগে দাঁড়িয়ে দেখেছি, কী অবলীলায় সেই কক্ষে ঢুকে যাচ্ছিল অঙ্গার হয়ে যাওয়া দেহগুলো।
আজ রোববার বেলা একটায় এসেছি মেডিকেলের জরুরি বিভাগে। করিডরে চিকিৎসক, রোগীদের স্বজন, গণমাধ্যমকর্মী আর স্বেচ্ছাসেবকদের ভিড়। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই দেখলাম, ভিড় ঠেলে সামনে এগোতে এগোতে পাসপোর্ট সাইজের ছবি তুলে ধরছিলেন এক যুবক। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমার ভাই মো. আবুল হোসেন। কেউ যদি সন্ধান পান জানাবেন।’
মধ্য ত্রিশের যুবক মো. রাসেল তাঁর ভাইকে খুঁজছেন। তাঁকে ঘিরে মুহূর্তেই ভিড় জমে উঠল গণমাধ্যমকর্মীদের। ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন তাক করে ধরা তাঁর দিকে। তবে তাতে তাঁর ভাবান্তর হলো না। ক্লান্ত-শ্রান্ত মুখ, চোখে চিকচিক করছে পানি।
সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার ভাই ডিপোতে লরি নিয়ে গিয়েছিল কনটেইনার আনতে। রাত ১০টার দিকে তার স্ত্রীকে ফোনে জানায়, ডিপোতে আগুন লেগেছে, আজ আর কাজ হবে না। বাড়ি চলে আসছে সে। এর পরপরই বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের পর থেকেই ভাইয়ের মোবাইল ফোন বন্ধ। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
ভিড় কমতেই কথা হয় রাসেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, গতকাল শনিবার রাত ১২টা থেকে চট্টগ্রাম আর সীতাকুণ্ডের ছয়টি হাসপাতালে ভাইকে খুঁজেছেন। কোথাও পাননি। গত রাত থেকে তাঁদের পরিবারের কেউই ঘুমাননি। কথা বলতে বলতে নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না রাসেল। চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘কই গেল আমার ভাইটা।’
ভিড়ের মধ্যে রাসেল হারিয়ে গেলেন। তাঁর কথার রেশ কাটতে না কাটতেই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের করিডরজুড়ে হঠাৎ ব্যস্ততা। রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকেরা ভিড় সরিয়ে দুই পাশে পথ করে দিতে দিতে বলছিলেন, ‘একটু সরে দাঁড়ান, সরে যান প্লিজ।’ কলাপসিবল গেট দিয়ে সেই পথে ঢুকল সাদা ব্যাগে মোড়া একটি মরদেহ। এক পাশে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া একটা পা বেরিয়ে এসেছে।স্বেচ্ছাসেবকেরা তাঁকে নিয়ে গেলেন ১৭ নম্বর কক্ষের দিকে। সেখানে ব্যাগে মোড়ানো সারি সারি লাশ মেঝেতে রাখা হয়েছে। ভিড়ের মধ্যে এক সাংবাদিক পাশে দাঁড়ানো স্বেচ্ছাসেবকের কাছে জানতে চান, ‘ইনি কি ফায়ার সার্ভিসের কেউ? একটু খবর নিয়ে জানাবেন?’
স্বেচ্ছাসেবক লাশের পেছন পেছন ছুটলেন সে তথ্য যাচাই করতে। জানা গেল, গতকাল রাতে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুনে পুড়ে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ছিলেন। রোববার বেলা দেড়টার দিকে যখন লাশটি করিডর দিয়ে ঢুকছিল, তখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪০ ছাড়িয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সংখ্যা আরও বাড়বে, এমন কথা বলছিলেন উদ্ধারকর্মী আর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা। শেষ পর্যন্ত ৪৯ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন।
মো. রাসেলের ভাই আবুল হোসেনের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সেই ভাবনা যখন মাথার মধ্যে ঘুরছিল, তখন ইমতিয়াজ হোসেন নামের গাউসিয়া কমিটির এক স্বেচ্ছাসেবক এলেন সংবাদকর্মীদের কাছে। ইমতিয়াজের হাতে একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি। সেটি তুলে ধরে বললেন, ‘লোকটির চেহারা চেনার উপায় নেই। তবে পকেটের মানিব্যাগের মধ্যে পাওয়া গেছে এই ছবি। আপনারা একটু প্রচার করলে হয়তো স্বজনেরা জানতে পারবেন।’
ছবির লোকটির গায়ে সাদা শার্ট। মুখে হালকা চাপ দাড়ি আর গোঁফ। বয়স বড়জোর ২৫ হবে। নাম না জানা মানুষটির কোনো স্বজনকে তখনো পাওয়া যায়নি। তাঁরও স্থান হয়েছে ১৭ নম্বর কক্ষে। সাদা ব্যাগে ঢাকা অন্যদের পাশে।
নিখোঁজ লরিচালক আবুল হোসেনের সন্ধানে আসা স্বজনদের খুঁজতে খুঁজতে চলে আসি ছয়তলায়। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সেখানে ৩৬ নম্বর বার্ন ইউনিট আর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণে আহত বেশ কয়েকজন ভর্তি আছেন। তাঁদের অনেকেই লরি আর প্রাইম মুভারের চালক।
বার্ন ইউনিটের ফটকে দাঁড়ানো বিএনসিসি আর স্কাউট স্বেচ্ছাসেবকেরা সাংবাদিকদের ঢুকতে দিচ্ছিলেন না ভেতরে। গেট থেকে ফিরে আসছিলাম, তখন এক তরুণ ডেকে বললেন, ‘আমাদের একজনের সঙ্গে যান, তিনি আপনাকে সব দেখাবেন।’
বার্ন ইউনিটের ওয়ার্ড আর বারান্দার মেঝেতেও আগুনে পোড়া রোগীদের রাখা হয়েছে। তবে এর মধ্যে সবাই সীতাকুণ্ডের নন। স্বেচ্ছাসেবক তরুণ আমাকে নিয়ে এলেন একটি শয্যার পাশে। সেখানে সারা শরীরে ব্যান্ডেজ মোড়ানো অক্সিজেন লাগানো এক মধ্যবয়স্ক রোগী অনেক চেষ্টা করে শ্বাস নিচ্ছিলেন। স্বেচ্ছাসেবক তরুণটি জানালেন, সীতাকুণ্ডের ঘটনায় আহত এই ব্যক্তির কোনো স্বজনকে পাওয়া যায়নি। জানা যায়নি তাঁর পরিচয়। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাঁর ওষুধপত্র ও চিকিৎসার খরচ জোগান দিচ্ছিল।
৩১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন ১৬ জন লরিচালক। বার্ন ইউনিটে স্থানসংকুলান হয়নি বলে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। রজ্জব আলীও ভর্তি আছেন তাঁদেরই সঙ্গে। তাঁর বিছানার কাছেই পাওয়া গেল চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ট্রেলার সমিতির যুগ্ম সম্পাদক হাসান মাহমুদকে। আহত চালকদের দেখতে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। হাসান বললেন, ওয়ার্ডে ১৬ জন চালক ভর্তি আছেন। এর মধ্যে গত রাতের ঘটনায় দুজন চালকের মৃত্যু হয়েছে। আরও কয়েকজন এখনো নিখোঁজ।
ওয়ার্ড থেকে বের হতেই দেখলাম জটলা। একটি কলেজ থেকে একদল শিক্ষার্থী এসেছেন খাবার নিয়ে। কলা, পাউরুটি, পানি, ওষুধ আর বিরিয়ানির প্যাকেট দিচ্ছিলেন তাঁরা আশপাশের লোকজনকে। একজন পানির বোতল হাতে নিয়ে জানতে চাইলেন, কার পানি লাগবে? পানি লাগবে কারও? খুব তৃষ্ণা পেয়েছিল। তাই এক বোতল পানি হাত বাড়িয়ে নিই তাঁদের কাছ থেকে। আহাজারি আর কাতরানির এমন জগতে এই এক বোতল পানি যেন একটু ভরসা দিল। এত দুর্বিপাকেও মানুষ অন্তত মানুষের পাশে আছে।