বাড়িতে মৃত্যুর ৬৫ শতাংশই জুলাইয়ে

লাশ
প্রতীকী ছবি

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন মামুন হোসাইন। ২৯ জুলাই করোনা শনাক্ত হয় তাঁর। দুই দিনের মাথায় হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হতে না পেরে বাসায় ফিরে আসেন। রাতে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় তাঁর। অক্সিমিটার দিয়ে মেপে দেখা যায়, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৫০–এর নিচে। শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকায় মধ্যরাতে বাসার কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর।

মামুনের দুজন সহকর্মী ও এক খালাতো ভাই প্রথম আলোকে বলেন, জ্বর, কাশি, গলাব্যথার সঙ্গে গন্ধ পাচ্ছিলেন না মামুন। রাতে কাশি বেড়ে শ্বাসকষ্ট হতো। বাসাতেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। করোনা শনাক্ত হওয়ার দুই দিন পর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) খোঁজে বের হয়ে প্রথমে একটি বেসরকারি হাসপাতাল ও পরে একটি সরকারি হাসপাতালে গিয়ে শয্যা পাননি। মাত্র ২৬ বছর বয়সেই চলে গেলেন মামুন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে ৩১ জুলাই পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২০ হাজার ৬৮৫ জন। এর মধ্যে বাসায় ও হাসপাতালে আসার পথে মারা গেছেন ৫৮৩ জন। এমন মৃত্যুর প্রায় ৬৫ শতাংশই (৩৭৬ জন) ছিল গত জুলাই মাসে। সর্বশেষ গতকাল রোববারও ১৪ জন করোনা রোগী বাসায় থেকে মারা গেছেন।

৬০ বছর বয়সী বরিশালের পাপিয়া বেগম করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাসাতেই ছিলেন। কয়েক দিন পর পরিস্থিতি খারাপ হলে ১ জুলাই মুলাদি থেকে বরিশালের শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পথে রওনা হন। পথেই মায়ের মৃত্যু হয় বলে জানান তাঁর ছেলে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি জটিল না থাকায় শুরুতে হাসপাতালে নেওয়ার কথা চিন্তা করেননি।

পটুয়াখালীর ৪৫ বছর বয়সী হালিমা বেগমের করোনা শনাক্ত হয় ২৬ জুলাই। সরকারি হাসপাতালের পরিস্থিতি দেখে ভর্তি হতে চাননি তিনি। দিনমজুর স্বামীর সংসারে টানাপোড়েন ছিল। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধও কিনতে পারেননি। গরম পানির ভাপ নেওয়া ও ঘরোয়া টোটকায় চিকিৎসা চলছিল। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে হাসপাতালেও নিয়ে যেতে পারেননি। ৩০ জুলাই বাসাতেই মৃত্যু হয় তাঁর। চট্টগ্রামে থাকা একমাত্র ছেলে মো. সুমন বলেন, টাকাপয়সার অভাবে মায়ের চিকিৎসা করাতে পারেননি।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা এবং বেসরকারি হাসপাতালে বেশি খরচের ভয়ে শহরের অনেকে হাসপাতালে যেতে চান না। শহরের চেয়ে গ্রামের পরিস্থিতি আরও খারাপ। আর্থিক অবস্থা, হাসপাতালে থাকা–খাওয়া, যাতায়াত, রোগীর সঙ্গে কে থাকবেন—এসব বিবেচনায় রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া একটি বড় সিদ্ধান্তের বিষয়। তাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনেকে অপেক্ষা করতে চান। অক্সিজেনের মাত্রা মাপার যন্ত্র অক্সিমিটারও নেই অনেক পরিবারে। নীরবে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলেও বুঝতে পারেন না রোগী। তাই হঠাৎ মৃত্যু হয়।

করোনার ডেলটা ধরনও (ভারতে শনাক্ত) ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। অনেকে আবার করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতেও যান না। তাই মৃত্যুর পর তাঁদের নামও ওঠে না সরকারি তালিকায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতাল নিয়ে সাধারণ মানুষের ভীতি আছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে অনিয়ম ও চিকিৎসা না পাওয়ার শঙ্কা বাদ দিয়ে সবাইকে হাসপাতালে আসতে হবে। ৪৫ বছরের বেশি বয়সী সবাইকে অবশ্যই চিকিৎসকের অধীনে থাকতে হবে।

কোনোভাবেই বাসায় বসে নিজে নিজে চিকিৎসা করা যাবে না। শেষ সময়ে হাসপাতালে এলে কিছুই করার থাকে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালের চেয়ে ১০ গুণ বেশি রোগী বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁদের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

কিন্তু এর বাইরেও করোনার উপসর্গ নিয়ে অনেকে বাসায় থাকছেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন। জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, গন্ধ চলে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিলে পরীক্ষা না করিয়ে করোনার সংক্রমণ হয়েছে বলে ধরে নেন কেউ কেউ। ফোনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাসাতেই থাকেন। মৃত্যুর পর তাঁদের করোনা সন্দেহে মৃত্যু হয়েছে বলে দাফন করা হয়। গত ২১ জুলাই উত্তরার জহুরুল ইসলাম করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান। আর গত ২৫ মে মারা যান মিরপুরের শিউলি বেগম। তাঁর ভগ্নিপতি ওয়াহেদ চৌধুরী বলেন, করোনার উপসর্গ নিয়ে কোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি শিউলি। তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত বছর জুন থেকে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বাসায় মৃত্যুর তথ্য দেওয়া শুরু করে। দেখা যায়, গত বছর জুলাইয়ের শুরুর দিকে বাসায় মৃত্যু বাড়তে থাকে। সেই সময় ১ থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত দেশে করোনায় মারা যান ৩৪৯ জন।

এর মধ্যে ৮৪ জনের মৃত্যু হয় বাসায় ও হাসপাতালে আনার পথে। এরপর ধীরে ধীরে এটি কমতে থাকে। এ বছর জুলাইয়ে এমন মৃত্যু আবার বাড়ছে। এখন পর্যন্ত দেশে করোনায় মোট মৃত্যুর প্রায় ৩ শতাংশ বাসায়। আর জুলাইয়ে মোট মৃত্যুর ৬ শতাংশ ছিল বাসায়।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে–নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সংক্রমণ এখন গ্রামে বেশি। তাই বাসায় মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে গেছে। সরকারি হাসপাতালে সেবার মান বাড়াতে হবে। ভালো চিকিৎসকের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে মানুষের আস্থা ফিরবে এবং তাঁরা হাসপাতালমুখী হবেন। এ ছাড়া করোনায় মৃত্যু কমানো যাবে না।