চিকিৎসায় গাফিলতি
বাচেনা খাতুনদের কে বাঁচাবে
চিকিৎসার মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পক্ষে সেখানে পৌঁছানো সহজ নয়।
২০ বছর ধরে পেটে কাঁচি নিয়ে ঘুরছিলেন আলমডাঙ্গার নওদাহাপানিয়া গ্রামের বাচেনা খাতুন। বছরের শুরুতেই এই গল্প ছড়িয়ে যায় সারা দেশে।
বাচেনা খাতুন মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা শহরের রাজা ক্লিনিক নামের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়েছিলেন ২০০২ সালে। পেটের ব্যথা থেকে মুক্তির আর কোনো উপায় ছিল না তাঁর। রাজা ক্লিনিকের পক্ষ থেকে তাঁকে জানানো হয়, পেট কেটে পাথর (পিত্তথলির পাথর) বের না করলে তাঁর ব্যথা যাবে না।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, ক্লিনিকের চিকিৎসক মিজানুর রহমান বাচেনা খাতুনের অস্ত্রোপচার করেছিলেন। এরপরও পেটের ভেতর মাঝেমধ্যে যন্ত্রণা করছিল। বাচেনা খাতুন স্থানীয় ওষুধের দোকান থেকে গ্যাস্ট্রিক ও ব্যথার ওষুধ খেয়েছেন, ভেবেছেন সব ঠিক হয়ে যাবে। সম্প্রতি পেটের সেই ব্যথা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেলে রাজশাহীর একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তিনি চিকিৎসার জন্য যান। সেখানে এক্স-রে করে দেখা যায়, তাঁর পেটের মধ্যে কাঁচি রয়েছে। এর আগে বারবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হলেও কাঁচি থাকার বিষয়টি ধরা পড়েনি।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ১০ জানুয়ারি বাচেনা খাতুনের শরীরে আরেকটি ‘সফল’ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাঁর পেট থেকে কাঁচিটি বের করা হয়। আপাতত বাচেনা খাতুন বেঁচে গেছেন।
এদিকে চিকিৎসকের ভুলে দুর্ভোগে পড়া বাচেনা খাতুনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং অভিযুক্তদের শাস্তির দাবি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আরজি জানানো হয়েছে। অবশ্য অভিযোগের জবাবে সংবাদ কর্মীদের কাছে সেই একই গীত গেয়েছেন অভিযুক্ত রাজা ক্লিনিকের স্বত্বাধিকারী ও চিকিৎসক পারভিয়াস হোসেন (রাজা)। তাঁর ভাষায়, ‘মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। মানুষের ভুল হবে এটাই স্বাভাবিক।’ তবে তিনি ভুক্তভোগী ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে বিষয়টি ‘সুরাহা’ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
সবার কপালের জোর বাচেনা খাতুনের মতো নয়। ২০২০ সালের ৩ মার্চ ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে মনিরা নামে এক তরুণীর অস্ত্রোপচার হয়। ওই সময় মনিরার পেটে কাঁচি রেখে সেলাই করে দেন চিকিৎসক। অপারেশনের কয়েক দিন পরেই মনিরার বিয়ে হয়। বিয়ের পরেও তাঁর পেটে ব্যথা ছিল। এরপর তিনি অন্তঃসত্ত্বা হন। পরে মনিরার পেটের বাচ্চা নষ্ট হলে তাঁকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেন স্বামী।
নানা চিকিৎসায়ও মনিরার পেটের ব্যথা কমেনি। ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে প্রায় দুই বছর ধরে তিনি পেটের ব্যথা চেপে রাখেন। ২০২১ সালের নভেম্বরে পেটের ব্যথা অসহনীয় হয়ে উঠলে তাঁকে মুকসুদপুরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নেওয়া হয়। সেখানে এক্স–রের মাধ্যমে পেটের ব্যথার রহস্য ধরা পড়ে। চিকিৎসকেরা দেখতে পান তাঁর পেটের মধ্যে একটি কাঁচি রয়েছে।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ডিসেম্বরে অস্ত্রোপচার করে মনিরার পেট থেকে কাঁচি বের করা হয়। এর মধ্যে তিনি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মলত্যাগের ক্ষমতা হারিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলার ক্ষমতাও নেই। স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন।
কাঁচি বের করার ওই অস্ত্রোপচারে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগে। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রতন কুমার সাহা গণমাধ্যমকে বলেন, কাঁচিটি দীর্ঘ দিন থাকার কারণে মনিরা খাতুনের নাড়ির কিছু অংশে পচন ধরেছে। পচন ধরা অংশগুলো কেটে ফেলতে হয়েছে। এমনও হতে পারে তাঁর কৃত্রিম নাড়ি লাগানোর দরকার হতে পারে। মনিরা খাতুনের সুস্থ হতে বেশ সময় লাগবে।
মনিরা এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু কুমিল্লার দেবীদ্বারের শারমিন আক্তারের মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। গত বছর (২০২১) পয়লা বৈশাখের দিন তিনি চলে যান চিরতরে। ঘটনার পাঁচ মাস (৫ নভেম্বর ২০২০) আগে চিকিৎসকদের পরামর্শে অস্ত্রোপচার করে তাঁর গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ঠ করানো হয়। ডা. রোজিনা আক্তার ও তাঁর সহযোগী ডা. শামীমা আক্তার কাজটি সম্পন্ন করেন।
অস্ত্রোপচারের দুই দিন পর থেকে শারমিনের পেটে ব্যথা হতে থাকে, হাসপাতাল থেকে এ সময় কিছু ওষুধ দেওয়া হয়। বাড়ি ফেরার পর অপারেশনের ক্ষত থেকে পুঁজ বের হতে থাকে। পরে ব্যথা আরও বেড়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নেন তিনি। ওষুধের পর ওষুধ খেতে থাকেন। ক্রমে তাঁর সমস্যা বাড়তেই থাকে। সংকটাপন্ন অবস্থায় ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলে জানা যায়, তাঁর পেটে গজ রেখেই আগের অস্ত্রোপচারটি সম্পন্ন করা হয়েছিল। পরে গত বছর ৬ এপ্রিল আবার অস্ত্রোপচার করে তাঁর পেট থেকে গজ বের করা হয়। অবশ্য মুনিরা বাঁচেননি, অস্ত্রোপচারের আট দিন পর তিনি মারা যান।
ত্রিশাল উপজেলার আমিরাবাড়ী গ্রামের ফজিলা আক্তার গত দুই বছর ধরে ভুগছেন। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মের প্রায় পাঁচ মাস পর আবার অস্ত্রোপচার করে তাঁর পেট থেকে আস্ত গজ বের করা হয় (সেপ্টেম্বর ২০২০)। গণমাধ্যমের খবর বলছে, গজ বের করার পর চিকিৎসক বলেন, রোগীকে বাঁচানোর স্বার্থে তাঁর ভুঁড়ির অনেকটা অংশ কেটে বিকল্প উপায়ে প্রস্রাবের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। এদিকে গত বছর জানুয়ারিতে আরও একটা অস্ত্রোপচার করতে হয়। ফজিলা আক্তার এখনো সুস্থ নন।
ক্ষতিগ্রস্তরা কি কোনো বিচার পান
বাচেনা খাতুনের দুর্ভোগের ঘটনা শুনে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার ইউএনও জানান, লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্য ওই ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ঘটনা সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেলে জেলা আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় কমিটির সভায় ঘটনাটি আলোচিত হয়। জেলা প্রশাসক সভাকে জানান, একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অবশ্য তদন্ত কমিটি আট দিন পর যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়, তাতে ঘটনার জন্য কে দায়ী তা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। কিংবা কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়নি। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, তদন্ত প্রতিবেদনে উল্টো বিদেশি কয়েকটি নিবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, বিভিন্ন দেশে এ জাতীয় ঘটনা আগেও ঘটেছে। অবশ্য প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে অস্ত্রোপচারের সময় অধিক সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়।
বলা বাহুল্য, বিদেশে এসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ ও জড়িতদের জবাবদিহির যে চর্চা আছে তা নিয়ে প্রতিবেদনে কোনো কথা বলা হয়নি। শেষ পর্যন্ত মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) আইনজীবী মো. শাহীনুজ্জামান ও সৈয়দা নাসরিন দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ এবং তাঁদের অবহেলার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ আরও পাঁচজনের বরাবর নোটিশ পাঠিয়েছেন। নোটিশ পাওয়ার পর ব্যবস্থা না নিলে তাঁরা রিট করতে পারেন।
দেবীদ্বারের ভুল চিকিৎসার বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সিভিল সার্জন তখন জানিয়েছিলেন, মৃত্যুর খবর পাওয়ার আগেই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়া গেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে তা জানা যায়নি। এর বাইরে ভালুকার ঘটনা নিয়ে তদন্তের কোনো উদ্যোগের কথা শোনা যায়নি।
ভুল চিকিৎসার সালিস
তদন্ত কমিটির গড়িমসি আর ‘ক্লিন চিট’ (দায়মুক্তি) দেওয়ার প্রবণতা দেখে ক্ষতিগ্রস্ত নিরুপায় মানুষ সালিসের দিকে ঝুঁকছেন। সম্প্রতি চিকিৎসাধীন এক প্রসূতির জরায়ু কেটে ফেলার অভিযোগ ওঠে একজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। সেই কর্মকর্তা একটি বেসরকারি ক্লিনিকে সিজার (সি-সেকশন) করতে গিয়ে ঘটনার সূত্রপাত হয়। নানা চাপে শেষ পর্যন্ত কথিত স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ভুক্তভোগী নারীর উন্নত চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। ঢাকায় তাঁর চিকিৎসা শুরু হয় ৬ জানুয়ারি।
আরেক ঘটনায় এক চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞের অপচিকিৎসায় চোখ হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আদালতের শরণাপন্ন হলে সালিস বসে। চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞের চেষ্টায় সেই সালিসে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অংশ নেন। রফা হয় ৭৫ হাজার টাকায়।
বন্ধের উপায় কী
দেশের হাসপাতালগুলোতে কোটি মানুষ চিকিৎসা নেন। হাজার হাজার অস্ত্রোপচার হয়। দু–একটি ক্ষেত্রে গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতার কারণে দায়িত্বশীল চিকিৎসকদের সুনাম যাতে নষ্ট না হয়, সেদিকে নজর দেওয়ার সময় এখনই। আর যে কেউ ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে হাসপাতালে হামলা করবে, সেটিও কাম্য নয়।
চিকিৎসা আর চিকিৎসকের মান নিয়ন্ত্রণ আর রক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের। মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন (২০১০) কাউন্সিলকে চিকিৎসকদের জন্য অনুসরণীয় পেশাগত আচরণের মান এবং এ–সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণ এবং প্রয়োগের দায়িত্ব দিয়েছে। কোনো চিকিৎসক পেশাগত দায়িত্বে অবহেলা করলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার কাউন্সিলের আছে। কাউন্সিল উচিত মনে করলে চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিত করতে পারেন। ওষুধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বীকৃত তালিকা ও মাত্রা অমান্য করলে সেটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করে কাউন্সিল ব্যবস্থা নিতে পারে।
মুশকিল হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পক্ষে কাউন্সিলের দরজা পর্যন্ত পৌঁছানো সহজ নয়। ধৈর্য আর আস্থা নিয়ে অবিচল থাকাও বেশ কঠিন, সবাই সব পারে না। গরিব–অসহায়দের পক্ষে সেটি প্রায় অসম্ভব। কাউন্সিল চিকিৎসার মান আর চিকিৎসকদের পেশাগত মান নজরদারির মধ্যে রাখার জন্য আরও উদ্যোগী হলে মানুষ ন্যায্য আচরণ পাবে, তাকে সালিসের পেছনে ছুটতে হবে না।
লেখক: গবেষক [email protected]