লোকটির নাম তোয়ো ম্রো। তবে বান্দরবানে চিম্বুক পাহাড়, রুমা, থানচি থেকে ত্রিপুরা ও বম সম্প্রদায়ের মানুষেরা সবাই তাঁকে চেনে একনামে—তোয়ো মাস্টার। পাহাড়ের জুমচাষিদের যাযাবর চাষের জীবন থেকে বাগানের চাষে আসার পথপ্রদর্শক তিনি। নিজে তো বাগান করে ভাগ্য বদল করেছেনই, অন্যদেরও শিখিয়েছেন বাগান করার কৌশল।
বদলে গেছে পুরো জনপদটার চিত্র। একদিন এই জনপদে ছিল খাদ্যাভাব। ম্রোদের মতে, চিম্বুক পাহাড়ে ম্রোলংপাড়া থেকে ডিম পাহাড় ও রংরাং পাহাড় হয়ে মিয়ানমার সীমানা পর্যন্ত শুধু ম্রো জনগোষ্ঠী বসবাস করে। এখানে মারমাদের পরে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ম্রো সম্প্রদায়। কিন্তু শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে অনগ্রসর হওয়ায় ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও শতভাগ জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
তোয়ো তখন ছোট। আবাসিক এক স্কুলে যেতেন। একদিন স্কুলের পাট সাঙ্গ করে তাঁকে নামতে হয় জুম চাষে। এক বছরের খোরপোশের জুম চাষ, প্রতিবছর জমি বদল। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জুমের জমির ওপর চাপ পড়ছে। আগের মতো আর ফসল হয় না। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল। এক বেলা খাবার জোটে তো আরেক বেলা জোটে না। সেই সময়ে একদিন ওয়ার্ল্ড ভিশনের কৃষক প্রশিক্ষণে জেলা শহরে এসেছিলেন। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) উচ্চ ফলনশীল রেড লেডি পেঁপে চাষ দেখানোর জন্য তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়। রেড লেডির উচ্চ ফলন দেখে তোয়ো ঠিক করেন, এ কাজটাতে ভাগ্য যাচাই করবেন তিনি।
২০০৫ সালে বিএডিসি থেকে রেড লেডির চারা নিয়ে বাগান শুরু করেন। শুরুতেই তিন লাখ টাকা আয় করে এলাকায় তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তিনি নিজেও অবাক হয়েছেন বাগানে এত লাভ দেখে। ২০০৭ সালে আমবাগান শুরু করেন। আম্রপালি, মল্লিকাসহ বিভিন্ন জাতের আমের বাগান। লাভজনক হওয়ায় স্থানীয় জাতের রাংগোয়াই চাষ করেছেন বেশি। তিনি নিজে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিএডিসি ও ওয়ার্ল্ড ভিশনে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এবং অন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। চিম্বুক পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। তিনি নিজেও চিম্বুক ফলচাষি সমবায় সমিতি গঠন করে সড়কের আশপাশে বসবাসরত লোকজনকে বাগান চাষে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
বান্দরবানের পাহাড়ের গল্প এখন অন্য কিছুই। চাষিরা এখানে ড্রাগন, আম, আপেল, কুল, সফেদা বাগান করেন। বাগানে সেচের জন্য স্তরে স্তরে উঁচু জায়গায় পানির ট্যাংক বসানো হয়েছে। দারুণ এ বাগান দেখতে দল বেঁধে মানুষ আসে।
সম্প্রতি সেরা কৃষি উদ্যোগ (ব্যক্তি) ক্যাটাগরিতে তীর-প্রথম আলো কৃষি পুরস্কার ২০১৮ পেয়েছেন তোয়ো মাস্টার।