বাসা থেকে কর্মস্থলে যাতায়াতের সুবিধার জন্য মোটর সাইকেল কিনেছিলেন সরকারি চাকরিজীবী নাজনীন আক্তার। এতে গণপরিবহন ব্যবহারের ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। পরে সেই বাইক তাঁকে অতিরিক্ত উপার্জনের সুযোগ করে দেয়। কর্মস্থলে আসা–যাওয়ার পথে তিনি এখন ‘রাইড শেয়ার’ করছেন। অর্থাৎ তাঁর মোটরসাইকেলে আরেকজন নারীকে তুলছেন অর্থের বিনিময়ে।
রাজধানীতে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং (বাইকে শরিকি যাত্রা) সেবা চালু হওয়ার পর তিনি প্রথমে ‘ও বোন’–এ নিবন্ধিত হন, যা শুধু নারীদের জন্য রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু শুরুতে নারীদের সাড়া না পাওয়ায় পরে তিনি ‘সহজ’–এ নিবন্ধিত হন। তবে নাজনীন নারীদের সাড়া না পেলেও অনেক নারীই এখন এই সেবা নিচ্ছেন। এত দিন তাঁদের কাছে বাসের একমাত্র বিকল্প ছিল অটোরিকশা।
কেন রাইড শেয়ারিং করছেন জানতে চাইলে নাজনীন আক্তার বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে অনেকেই অনৈতিকভাবে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করেন। কিন্তু আমি সে পথে যেতে চাইনি। রাইড শেয়ারিং আমাকে বৈধভাবে অতিরিক্ত আয়ের পথ করে দিয়েছে।’ দিনে তিন–চারটি রাইড শেয়ার করলেও মাসে প্রায় ছয় হাজার টাকা উপার্জন করা সম্ভব। আর এটিকে মূল পেশা হিসেবে নিলে মাসে ২৮–৩০ হাজার টাকা উপার্জন করা যায় বলে জানালেন তিনি।
দেশের প্রথম সারির কয়েকটি রাইড শেয়ারিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নারীরা কমবেশি যুক্ত আছেন। ‘পাঠাও’, ‘উবার’ ও ‘সহজ’–এ নারী রাইডাররা নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার সঙ্গে রাইড শেয়ার করেন। পাশাপাশি ‘ও বোন’ আর ‘লিলি’ নামের দুটি অ্যাপের মাধ্যমে শুধু নারীদের জন্য নারী রাইডারের (চালক) ব্যবস্থা আছে। কতজন নারী চালক কাজ করছেন, জানতে চাইলে লিলি কর্তৃপক্ষ তা জানাতে অস্বীকৃতি জানায়। অন্যদিকে ‘ও বোন’–এর সঙ্গে আছেন ২০ জনের বেশি নারী চালক। পাঠাও কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের দেড় লাখ চালকের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার নারী। ‘সহজ’–এর সঙ্গে কাজ করছেন অর্ধশতাধিক নারী চালক। আর উবার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ই–মেইলে যোগাযোগ করা হলেও উত্তর পাওয়া যায়নি।
তবে এসব কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে নারীরা রাইড শেয়ার করছেন তাঁদের সিংহভাগই খণ্ডকালীন কাজ করেন। তাঁদের তথ্যমতে, ৯০ শতাংশের বেশি নারী রাইডার খণ্ডকালীন কাজ করেন, আর বাকিরা পূর্ণকালীন। খণ্ডকালীন রাইডাররা মাসে ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা আর পূর্ণকালীন রাইডাররা ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। অনেকে বোনাসও পাচ্ছেন।
লিলির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মো. সাইফুল্লাহ্ জানান, তাঁরা নারীদের এ কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছেন। নারীদের বাইক চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। যে নারীরা গার্মেন্টসে কাজ করতে ইচ্ছুক নন, আবার অন্য কোনো কাজ করার মতো দক্ষতাও নেই, সেই নারীদের তাঁরা বাইক সেবায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। তিনি আশা করছেন, আগামী দু-এক বছরের মধ্যে উল্লেখসংখ্যক নারী এ পেশার সঙ্গে যুক্ত হবেন।
এই খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা, নিরাপত্তা প্রভৃতি কারণে রাইড শেয়ারিংয়ে নারী চালকের সংখ্যা কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না। একজন নারী পুরুষের সঙ্গে বাইকে উঠবেন, আমাদের সমাজ এখনো তা ভালোভাবে নেয় না। এ ছাড়া নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা আছে।’
জানতে চাইলে ‘সহজ’–এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা কাদির বলেন, ‘নারী হিসেবে নারীর ক্ষমতায়ন ও নিরাপত্তার ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নারীরা যে এই সেবাকে পেশাদারির সঙ্গে গ্রহণ করছেন, তাতে আমরা খুবই খুশি।’
এই সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দেশে নারীদের বাইক চালানোর হার বাড়ছে। তবে যাঁরা বাইক কিনছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সচ্ছল। তাই অনেকেই শরিকি যাত্রায় আগ্রহ বোধ করেন না। নারী চালকের সংখ্যা না বাড়ার পেছনে এটিও একটি কারণ। শত বাধা সত্ত্বেও কেউ কেউ এগিয়ে আসছেন, এটা ইতিবাচক।