শীত এখনো জাঁকিয়ে বসেনি। তবে রাজধানীতে হেমন্তের বেলা শেষের হাওয়ায় লেগেছে তার স্পর্শ। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনের কবোষ্ণ সন্ধ্যায় আমন্ত্রিত অতিথিরা একে একে এসে সমবেত হচ্ছিলেন সোনারগাঁও হোটেলের ওয়েসিস চত্বরে। প্রথম আলো তার শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে প্রীতিসমাবেশের আয়োজন করেছিল ১৭তম বর্ষপূতি উপলক্ষে।
দেশের শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা, ব্যবসা, ক্রীড়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রয়াত কৃতীজনদের সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ প্রতিকৃতি, রঙিন আলো ও নানান উপকরণে উৎসবের উপযোগী করে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল ওয়েসিসের সবুজ চত্বর। সেখানে সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ, রাজনীতিক, বিদেশি কূটনীতিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী, পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, ক্রীড়াবিদ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বরা অংশ নিয়েছেন এই আনন্দঘন সমাবেশে।
বরাবর যেমন হয়—আনুষ্ঠানিকতার পর্ব থাকে সংক্ষিপ্ত, এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। অতিথিরা কোমল পানীয় ও হালকা খাবারের সঙ্গে মনোরম এই সন্ধ্যা উপভোগ করেছেন পরস্পরের চেনাজানা ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় ও অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায়। এই প্রবল ব্যস্ত নাগরিক জীবনে ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় অনেক কাছের মানুষের সঙ্গে অনেক দিন দেখা-সাক্ষাৎ করাটা হয়ে ওঠে না। প্রথম আলোর বর্ষপূতির প্রীতিসম্মিলনী সে সুযোগটি তৈরি করেছিল। ফলে সুধীজনের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল আয়োজনটি। সূর্য ডোবার পর শুরু হয়েছিল আনুষ্ঠানিকতার পর্ব। অতিথিদের আসা-যাওয়া ছিল বেশ খানিকটা রাত অবধি।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক অতিথিদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেন, গান দিয়েই শুরু হোক। দেশের স্বনামখ্যাত শিল্পীরা গেয়ে শোনালেন ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায়’সহ একাধিক গানের অংশবিশেষ।
গানের পর আমন্ত্রিত অতিথিদের স্বাগত জানান ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আপনারা এখানে যাঁরা আছেন এবং সারা দেশে আমাদের যে ৫৫ লাখ পাঠক ছড়িয়ে আছেন, এই আনন্দঘন দিনে তাঁদের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন। আপনাদের সমর্থন ও সহযোগিতার ফলেই প্রথম আলোর আজকের এই সাফল্য। সব বিচারের শেষে, যে পাঠক রোজ সকালে তাঁর কষ্টার্জিত অর্থে ১০ টাকা দিয়ে প্রথম আলো কেনেন, তাঁরাই প্রথম আলোর প্রধান শক্তি। প্রথম আলো তাঁদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে বলেই তাঁরা পত্রিকাটি কেনেন। তিনি বলেন, প্রথম আলো তার মূল্যবোধ, নীতিমালা ও প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুত হবে না। প্রথম আলোর এই ১৭ বছরের যাত্রাপথ সহজ ছিল না। নানা পর্যায়ের চাপ অতীতে ছিল, এখনো আছে, কিন্তু প্রথম আলো আপস করেনি, মনোবল হারায়নি। হারাবে না। পক্ষপাত বা উদ্দেশ্যমূলক কোনো কিছুর সঙ্গে অতীতে ছিল না, ভবিষ্যতেও সততা ও নিরপেক্ষতা বজায়ে রেখে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যাবে।
এরপর ছিল আবেগ ও উদ্দীপনাময় একটি ছোট্ট পর্ব। প্রথম আলো এবারের বর্ষপূর্তিতে এমন একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছে, যেখানে আছে দেশের প্রান্তবর্তী এক পাহাড়ি এলাকার অদম্য কিশোরীদের স্বপ্নজয়ের কাহিনি। ‘অদম্য মেয়েরা’ নামের এই প্রামাণ্যচিত্রে দেখানো হয় ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের পাদদেশে ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর নামের এক নিভৃত পল্লির একদল কিশোরী অনুশীলন করছে ফুটবলের। কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মফিজ উদ্দিন তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। কঠিন দারিদ্র্য ও অন্যান্য বাধার সঙ্গে লড়াই করে এই মেয়েরা স্বপ্নজয়ের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৪ বছরের ফুটবলে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে মেয়েদের অনূর্ধ্ব ১৪ বছরের ফুটবলে চূড়ান্ত পর্বে উঠেছিল। তবে নেপালে ভূমিকম্পের ফলে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতাটি স্থগিত হয়ে যায়।
প্রামাণ্যচিত্রটি অতিথি দর্শকদের আপ্লুত করে তোলে। প্রদর্শনী শেষে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বক্তব্য দিতে এসে কলসিন্দুর গ্রামের এই অদম্য মেয়ে ও তাদের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল, শিক্ষক মফিজ উদ্দিন, জালাল উদ্দিনকে মঞ্চে ডেকে নেন। তাঁরা মঞ্চে এলে অনুষ্ঠানে এক আবেগময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সবাই বিপুল করতালি দিয়ে তাঁদের অভিনন্দন জানান। মতিউর রহমান প্রথম আলোর বর্ষপূতির এই আয়োজন কলসিন্দুরের কৃতী মেয়েদের প্রতি উৎসর্গ করেন। তিনি জানান, প্রথম আলোতে এই মেয়েদের সাফল্যের কথা বিস্তারিতভাবে ছাপা হয়েছিল। প্রথম আলো এই মেয়েদের বৃত্তি দেবে, কলসিন্দুর স্কুলের সঙ্গে থাকবে।
মতিউর রহমান বলেন, ‘যে ১৬ কোটি মানুষ তাদের শ্রম মেধা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমরা তাদের সঙ্গে আছি, এটাই আমাদের এজেন্ডা। বাংলাদেশের জয় আমাদের এজেন্ডা।’ তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক একটি মানবিক সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে আমরা প্রথম আলো প্রকাশ করি। আমাদের একটি ঘোষিত ও লিখিত নীতিমালা আছে। সেই নীতিমালার আলোকে আমাদের ভূমিকা অব্যাহত থাকবে। কোনো দেশেই ক্ষমতার সঙ্গে সংবাদপত্রের সম্পর্ক নিরঙ্কুশভাবে মধুর হয় না। আমাদের ওপর চাপ আছে। দুর্নীতির দিকে ঝুঁকে পড়া ক্ষমতাপ্রত্যাশীদের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। সংবাদপত্রের কাজ ক্ষমতাকে পাহারা দিয়ে রাখা। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সহায়তা করা। প্রথম আলোর বিপুল পাঠক আমাদের প্রধান শক্তি। এই শক্তিকে নিয়েই চাপের মুখে নতিস্বীকার না করে প্রথম আলো তার লক্ষ্যের দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখবে।’ তিনি ১৭তম বর্ষপূতির আনন্দঘন দিনে পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্ট, হকারসহ সব শুভানুধ্যায়ীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ও তাঁদের উষ্ণ অভিনন্দন জানান।
আনুষ্ঠানিকতা বলতে এটুকুই। তারপর সান্ধ্যভোজ আর প্রাণবন্ত আড্ডা। পেরিয়ে গেছে চমৎকার এক হৈমন্তী সন্ধ্যা।
আরও পড়ুন: