বাংলা ভাষার আপদ-বালাই-বিষণ্ণতা

একুশে ফেব্রুয়ারি
ফাইল ছবি

হাসান হাফিজুর রহমানের ‘অমর একুশে’ নামে একটি কবিতা আছে। কবিতাটিতে কবি একটি চরণে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদ বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারের নাম উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘কি আশ্চর্য, কি বিষণ্ণ নাম!’ কবিতাটিতে ওই নামগুলো আর বাংলা ভাষা যেন সমার্থক হয়ে উঠেছে। কবিতাটির চরণটিতে তিনি দুটি বিশেষণ ব্যবহার করেছেন, ‘আশ্চর্য’ আর ‘বিষণ্ণ’। আশ্চর্য নাম তো বটেই! ভাষার অধিকারকে যাঁরা অস্তিত্বের সমার্থক করে তুলেছিলেন এবং আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, তাঁরা ‘আশ্চর্য’ তো বটেই! কিন্তু বাংলা ভাষার বর্তমান আর অতীতের দিকে চোখ রাখলে ‘আশ্চর্য’ শব্দটিকে ডিঙিয়ে ওই ‘বিষণ্ণ’ শব্দটি কেবল জলের মতো ঘোরে এবং আমাদের ক্রমাগত বিষণ্ণ করে তোলে।

‘বিষণ্ণ’ শব্দটিকে হাসান কেন ব্যবহার করেছিলেন! বোঝা যায়, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শহীদেরা অকালে অন্যায় হত্যার শিকার হয়েছিলেন। এ ঘটনা ‘বিষণ্ণ’ হওয়ার মতোই বটে। কিন্তু শব্দটি কি কবির অজান্তে বাংলা ভাষার অতীত আর ভবিষ্যতের যাবতীয় বিষণ্ণতাকে শুষে নিয়ে বাষ্পাকুল হয়ে আছে!

বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছিল প্রাকৃতজনের মুখে। মানে, বাংলা অঞ্চলের ব্রাত্যজনের মুখের ভাষা থেকেই এ ভাষার উদ্ভব। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম লিখিত নিদর্শন চর্যাপদ এবং ভাষাবিদদের ধারণা অন্তত সে সাক্ষ্যই দেয়। এরপর এই গরিব সাধারণ মানুষের ভাষাটি সংস্কৃত, ফারসি, উর্দু, ইংরেজির মতো বড় বড় রাজভাষার দৌরাত্ম্যের ভেতর দিয়ে নানা চড়াই-উতরাই পার করেছে। রাজভাষা হওয়ার সৌভাগ্য এ ভাষার কপালে জোটেনি বললেই চলে। তবে রাজানুগ্রহ যে পেয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। কখনো বিভাষী তুর্কিদের, সুলতানদের, কখনো পাঠানদের, আবার কখনোবা রোসাঙ্গ রাজার।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়তে গেলে মাঝেমধ্যেই মনে হয়, দরিদ্র যেমন বড়লোকের আনুকূল্যে বেঁচেবর্তে যায়, বাংলাও যেন খুদকুঁড়োটি খেয়ে কোনোরকম বেঁচেবর্তে গিয়েছে। সে এক বিষণ্ণ ইতিহাসই বটে। অন্তত আমাদের মূলধারার ইতিহাস পড়লে এ বিষণ্ণতার বোধই জাগে বটে। ভাষাটি বহুকাল কোনো অভিজাতের মুখের ও লেখার ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। সাধারণ গরিব আম-মানুষের মুখ-কান আর ওই শ্রেণি থেকে আগত বাংলাভাষী কবি–সাহিত্যিকদের প্রগাঢ় প্রেমে ভাষাটি কোনো রকমভাবে বেড়ে উঠেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজের প্রশাসনিক রাজধানী ছিল কলকাতা। ফলে এখানে সীমিত অর্থে হলেও একটা ‘নতুন জীবনের স্পন্দন’ শুরু হয় সনাতনি বাঙালি সমাজের মধ্যে। ক্রমে রাজনৈতিক একটা জাগরণও ঘটে এখানে। বহু মানুষের বিচিত্র চর্চার সঙ্গে বাঙালির রাজনৈতিক গুরুত্ব যুক্ত হয়ে এখানকার বাংলা ভাষাটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রাজধানী কলকাতায় ইংরেজির প্রবল প্রতাপের মধ্যে থেকেও ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে এ ভাষার ব্যাপক সাহিত্যিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। রবীন্দ্রনাথের পৌরোহিত্যে এ ভাষা বিশেষ একটা মর্যাদার আসনে আসীন হয়। শুধু নোবেল প্রাপ্তির দিক থেকে নয়, ‘লোকসমাজের ও সাহিত্যের প্রায় সব রকম বক্তব্যই খুব ভালো করে প্রকাশের’ সক্ষমতার দিক থেকেও এ ভাষা বিশেষ উচ্চতা লাভ করে। ইংরেজির প্রবল আধিপত্যের মধ্যেও কিছু অভিজাতের মনোযোগ আর কদরও সে লাভ করে। বাংলা ভাষা নিয়ে বাঙালির মধ্যে একটা শ্লাঘাও তৈরি হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের বাংলা ভাষার সাহিত্যিক রূপ সম্পর্কে জীবনানন্দ দাশ বেশ শ্লাঘা বোধ করেই বলেছিলেন যে, ‘ইংরেজি বা ফরাসির থেকে বাংলা বস্তুত খুব বেশি পিছে পড়ে নেই...।’

একুশে ফেব্রুয়ারি
ফাইল ছবি

তারপর বাংলা ভাষাটি আবার বড় ধাক্কা খেল দেশভাগের ভেতর দিয়ে। পশ্চিম বাংলায় সে হিন্দি আর ইংরেজির দাপটের মধ্যে পড়ল। আর পূর্ব বাংলায় পড়ল উর্দু আভিজাত্যের প্রবল চাপের মধ্যে। পশ্চিম বাংলা সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না পারলেও পূর্ব বাংলা অনেক রক্তের বিনিময়ে সে-বালাই কাটিয়ে ওঠে। বাংলা ভাষার কপালে যা আগে জোটেনি, সেই ঘটনাটি ঘটাল পূর্ব বাংলার মানুষ। রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় সমাসীন করল। শুধু তাই নয়, এ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় উন্মেষ ঘটল এক নতুন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার। এ চেতনার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটল বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে। বাংলা এই প্রথম রাজভাষা হলো; একক রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করল। ‘দুঃখিনী’ বাংলার মুখে হাসি যেন আর ধরে না। তার বিষণ্ণতার দিনের যেন অবসান হলো।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়তে গেলে মাঝেমধ্যেই মনে হয়, দরিদ্র যেমন বড়লোকের আনুকূল্যে বেঁচেবর্তে যায়, বাংলাও যেন খুদকুঁড়োটি খেয়ে কোনোরকম বেঁচেবর্তে গিয়েছে।

কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলেও সে যেন ব্যবহারগতভাবে পরিপূর্ণ মর্যাদাটা আজও পেল না। রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার আজও নিশ্চিত হলো না। উচ্চশিক্ষা, উচ্চ-আদালত, রাষ্ট্রীয় উচ্চতর গবেষণা কোথাও বাংলার স্থান অদ্যাবধি হলো না। ইংরেজি বিদ্যা কেনার টাকা আছে, বাংলাদেশে এমন কেউ আজকাল আর তাঁর সন্তানকে বাংলা মাধ্যমে পড়ান না। কারণ, আভিজাত্যের তকমার সঙ্গে বাংলা তার নামটা যুক্ত করতে পারেনি। আভিজাত্যের আর সুযোগ-সুবিধার পুরোটাই ভোগ করে এখন ইংরেজি। পাকিস্তান আমলে যেমন ছিল উর্দু। এখন যাঁরা তাঁদের সন্তানদের বাংলা মাধ্যমে পড়ান, তাঁরা ওই সেই গরিব সংখ্যাগরিষ্ঠ, যাঁদের মুখে আজতক অনেক বিষণ্ণতার ভেতর দিয়ে নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে হাজার বছর ধরে বাংলা আজও টিকে আছে এবং আরও বহুকাল থাকবে হয়তো।

আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, ভাষার নামে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে, বাংলা ভাষার শেষ আশ্রয় বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রভাষা বাংলা কায়েম হোক। রাষ্ট্রের সর্বস্তরে চালু হোক বাংলা। বাংলা ভাষার ওপর থেকে বিষণ্ণতার আচ্ছাদন নেমে যাক। তার কপাল থেকে মুছে যাক দীর্ঘ দুঃখের গভীর রেখা। রফিক, শফিক, বরকত, সালাম, জব্বারদের নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সর্বস্তরের বাঙালির মনের মধ্যে বিষণ্ণতাকে ডিঙিয়ে লাফিয়ে উঠুক হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতায় ব্যবহৃত অহংকার আর বিস্ময়ে ভরা ‘আশ্চর্য’ বিশেষণটি।