বাংলা বানান শিখতে হবে যত্ন নিয়ে
ব্যানার, পোস্টার, সাইনবোর্ডে ছাওয়া এই রাজধানীতে ভুল বানান খুঁজতে বেগ পেতে হয় না। এদিক-সেদিক তাকালেই বাংলা বানানের দুর্দশা চোখে পড়বে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সে ভুলের বাহার এখন আরও প্রকট। ভুল এবং দুর্বোধ্য শব্দের ছড়াছড়ি সেখানে। ভুল বাংলায় কিছু লেখা হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ব্যঙ্গ করে ‘মুরাদ টাকলা’ খেতাব দেওয়া হয়।
মতিঝিলের একটি রেস্তোরাঁর বাইরে খাবারের দামসহ তালিকা টাঙানো। সেখানে চায়নিজ হয়ে গেছে ‘চাইনসে’, ভ্যাট আছে ‘ভাট’ হিসেবে, রোস্ট ভেঙে ‘রসট’ হয়ে গেছে। শহরের যেকোনো রাস্তা ধরে হাঁটলে অন্তত কোনো না–কোনো ভুল বানানের সাইনবোর্ড, পোস্টার বা লেখা চোখে পড়বেই।
যানবাহনগুলোর পেছনে নানান ধরনের উপদেশমূলক বাণী লেখা থাকে। প্রায়ই চোখে পড়ে ভুল বানানের উপদেশ। ছোট-বড় দোকানেও কম যায় না ভুল বানানের বাহারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভুল বানান ও বাক্য প্রচুর দেখা যায়। ভুল বানানের কারণে একটি শব্দের অর্থই অনেক সময় ভিন্ন কিছু দাঁড়ায়। ফেসবুকে ‘স্যাড বাট ট্রু’ এবং ‘মুরাদ টাকলা’ নামে জনপ্রিয় গ্রুপ ও পেইজ আছে। সেখানে বিভিন্ন ভুল বানান ও একেকজনের দেওয়া ভুলে ভরা পোস্ট দেখা যায়।
বানান বা ভুল বাক্য লেখা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, না জেনে বানান ভুল লেখা সামান্য হলেও সেখানে আপত্তি থাকবে। কারণ, এটা নিজের ভাষা যত্ন করে না শেখার ফল। তিনি বলেন, ‘ইংরেজি ভাষার বানান ভুল হলে আমরা লজ্জিত হই বা আরেকজন হাসবে বা ভর্ৎসনা করবে, এই ভয়ে আমরা তটস্থ থাকি। খুবই যত্ন করে ইংরেজিটা শিখি। কিন্তু নিজের মাতৃভাষা বলে বাংলাকে অবহেলা করে শিখি, যত্ন নিয়ে শিখি না। যার ফলে বানানে, ভাষায় বা বাক্যবিন্যাস সম্পর্কে আমাদের অযত্নের ছাপ থাকে।’
যত্ন নিয়ে নিজের ভাষা শেখার দরকার আছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। তিনি বলেন, বানান ও ভাষার বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে হবে। ভাষার মাসে বা সারা বছর এই বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সাইফিন রুবাইয়াত বলেন, ‘বানান অবশ্যই শুদ্ধ করে বলতে এবং লিখতে পারা উচিত। বানান ভুল হয় অজ্ঞতা থেকে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখার ক্ষেত্রে ফোনেটিক ব্যবহার হয়। এতেও বানান ভুল হয়। এ জন্য প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা কাটাতে হবে।’
ভাষাকে ভালোবাসতে হবে বলে জানান সাইফিন রুবাইয়াত। এ জন্য তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাষা ও বানানের প্রতি জোর দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বানান চর্চার জন্য শিক্ষার গোড়ায় আমাদের হাত দেওয়া দরকার। ভাষা শিক্ষার ভিত তৈরি হয় বিদ্যালয়ে। স্কুলগুলো হয়তো বানানগুলোর ব্যাপারে যত্নশীল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যা দেখি, ভাষা–সম্পর্কিত যেসব বিষয় আছে সেসব বিষয় ছাড়া বা অন্য বিষয়ে বানানের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সব জায়গায় যেহেতু বাংলাকে এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তাই শিক্ষকদের দায়িত্ব নিতে হবে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিন্ন ঢঙে লেখা বা শব্দের ভাঙাচোরাকে স্বাভাবিকভাবেই দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদুল হক। তিনি বলেন, ‘প্রমিত ভাষার নির্দিষ্ট কিছু জায়গা আছে, লেখালেখিতে, বইপুস্তকে, অফিসে কিংবা সংবাদ পাঠে- এগুলোতে প্রমিত ভাষার ব্যবহার হতে হবে। কিন্তু ক্যাজুয়াল ঢঙে ইনফরমাল জায়গায় ভাঙাচোরা করলে আমি মনে করি যে এতে ভাষা সমৃদ্ধই হয়। অনেক সময় বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহারও সম্ভব।’
ভাষার বিবর্তনের কথা টেনে ফাহমিদুল হক বলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বা শরৎচন্দ্রের সময় এসে সহজ-সরল হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের সময় তা আরও সহজ-সরল হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই না ভাষার পতন হয়েছে বা অপমান করা হয়েছে। নিজস্ব নিয়মেই এই পরিবর্তনগুলো হয়। সাইনবোর্ড ও পোস্টারের বানান ভুলের ব্যাপারে বলেন, যখন প্রমিত বাংলা ব্যবহার হচ্ছে তা সেভাবেই করতে হবে।
কিশোর বয়সী যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিচরণ করে তাদের বানান ও ভাষার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, তারা বইয়ের ভাষা এক রকম করে শিখছে আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভিন্ন রকমভাবে দেখছে। এতে হয়তো ভাষার ‘ক্যাজুয়াল’ ব্যবহারের প্রতি তাদের আকৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে পাঠ্যপুস্তকে বা ফরমাল ভাষা শিক্ষাটা যেন সঠিকভাবে হয়, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। প্রমিত ভাষাকে দরকার। কিন্তু প্রমিতই একমাত্র শুদ্ধতার দাবিদার না।