বরাদ্দের টাকা ফেরত যাচ্ছে

বরাদ্দ পেয়েও খরচ করতে পারেনি অনেক উপজেলা হাসপাতাল। উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা দেওয়া গেলে জেলা হাসপাতালগুলোতে চাপ কমত।

করোনা রোগীদের ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে গত বছর দেশের প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। এই টাকা করোনা রোগীদের চিকিৎসা প্রস্তুতি, সরঞ্জাম ক্রয়সহ বেশ কিছু খাতে খরচ করার কথা। কিন্তু অনেক উপজেলায় একটি টাকাও খরচ করা হয়নি। ফলে এই টাকা ফেরত গেছে। কিছু উপজেলায় আংশিক খরচ করা হয়েছে। উপজেলাগুলোতে চলতি বছর আবারও তিন লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

করোনা রোগীদের চিকিৎসায় অনেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রস্তুতির ঘাটতি রয়ে গেছে। দেশে আবার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় (বিশেষ করে সীমান্তের জেলাগুলোতে) উপজেলা পর্যায়ের করোনা রোগীদের দ্রুত জেলা সদর বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা সদর হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ৭২টি শয্যার প্রতিটিতেই গত বৃহস্পতিবার রোগী ভর্তি ছিল। অথচ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে করোনার জন্য নির্ধারিত শয্যার প্রায় সবই ফাঁকা। জেলার ভোলাহাট, গোমস্তাপুর, শিবগঞ্জ ও নাচোল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে ভোলাহাট ও শিবগঞ্জ উপজেলায় সরকারের বরাদ্দ দেওয়া তিন লাখ টাকা থেকে কোনো টাকা খরচ হয়নি। শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সায়রা খান প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করা হয়নি। খরচের বিল-ভাউচার তৈরি করার ঝামেলা এড়ানোর জন্য এ খাতে কোনো খরচ দেখানো হয়নি।

দেশে গত বছরের ৮ মার্চ করোনার প্রথম সংক্রমণের কথা জানায় সরকার। প্রথম দফায় সংক্রমণ বাড়তে থাকায় গত বছরের এপ্রিলে দেশেরপ্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। করোনা রোগীদের ব্যবস্থাপনা, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ক্রয়, করোনা রোগীদের ওষুধসামগ্রী, গজ, ব্যান্ডেজ ও তুলা, রাসায়নিক রি–এজেন্ট, অক্সিজেন সরবরাহ ও ক্রয় ইত্যাদি কাজে এই অর্থ ব্যবহার করার কথা উল্লেখ করা হয়।

যশোরের মনিরামপুর উপজেলার পারখাজুরা গ্রামের বাসিন্দা আবুবক্কর সিদ্দিকী করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। শ্বাসকষ্ট কমাতে তাঁকে দেওয়া হয়েছে অক্সিজেন। শয্যাসংকটের কারণে মেঝেতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন ৫০ বছর বয়সী আবুবক্কর। গতকাল যশোরের ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে।
ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

গত সপ্তাহে দেশের ১১টি জেলার ৪৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এই বরাদ্দের তথ্য নেয় প্রথম আলো। এগুলোর মধ্যে ১১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তিন লাখ টাকার একটি টাকাও খরচ হয়নি। ফলে পুরো টাকাই ফেরত দেওয়া হয়েছে। আংশিক টাকা খরচ হয়েছে ১০টি উপজেলায়। অন্যদিকে পুরো টাকাই খরচ হয়েছে ২১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। আর তিনটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে বরাদ্দের অর্থের বিষয়ে তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে শুধু টাকা খরচের কথা জানানো হয়েছে, কিন্তু কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে, সেটির সুনির্দিষ্ট তথ্য দেওয়া হয়নি।

যাঁরা খরচ করতে পারেননি, সেই উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও চিকিৎসকেরা বলছেন, অর্থ ছাড়ে বিলম্ব হয়েছে। গত অর্থবছরের শেষে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, শেষ সময়ে বরাদ্দ পাওয়ায় অনেকেই খরচ করেননি। বরাদ্দের টাকা কোন খাতে কীভাবে খরচ হবে, তার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল না।

ফেরত গেছে পুরো টাকাই

দিনাজপুরের পাঁচটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টাকাই ফেরত চলে গেছে। দুটি উপজেলায় আংশিক খরচ হয়েছে। ঘোড়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নুর নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার শুরুতে তিন লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছিল। হাসপাতালে রোগী ছিল না। তাই খরচ করা হয়নি। টাকা খরচ করে পরবর্তী সময়ে অডিটের ঝামেলায় পড়ার দরকার কী?’

সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী উপজেলা কলারোয়া, দেবহাটা, কালীগঞ্জ ও শ্যামনগরের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঁচটি করে আইসোলেশন শয্যা রয়েছে। করোনা উপসর্গ থাকা রোগীদের সেখানে প্রাথমিকভাবে ভর্তি করা হয়। নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হলেই সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। করোনা শনাক্ত রোগীদের এখানে ভর্তি করা হয় না। অথচ কলারোয়া, দেবহাটা ও কালীগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য বরাদ্দ করা তিন লাখ টাকা ব্যয় না হওয়ায় ফেরত গেছে।

মেহেরপুরের গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলার করোনা শনাক্ত রোগীদের জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। গত বছর বরাদ্দ আসা তিন লাখ টাকার পুরোটাই ফেরত দেওয়া হয়েছিল। গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা এম কে রেজা বলেন, গত বছর যে সময় বরাদ্দ এসে পৌঁছায়, তখন উপজেলাতে সংক্রমণের হার কমে এসেছিল। টাকা খরচ করা যায়নি।

কিছু খরচ, কিছু ফেরত

দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলায় প্রথম দফায় বরাদ্দের ১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আবুল বাশার মো. সায়েদুজ্জামান বলেন, ওই টাকা দিয়ে আইসোলেশন ওয়ার্ড, ভর্তি রোগীদের থাকা–খাওয়া, গ্রামে গ্রামে গিয়ে নমুনা সংগ্রহে ব্যয় করা হয়েছে। বাকি টাকা উত্তোলন ও খরচ করা যায়নি।

নওগাঁর বদলগাছি, পত্নীতলা, সাপাহার ও ধামইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের বরাদ্দের ৬০ শতাংশের মতো ব্যবহৃত হয়েছে। নওগাঁর সিভিল সার্জন এ বি এম আবু হানিফ বলেন, ‘বরাদ্দের এই টাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সরাসরি সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই টাকার ব্যবস্থাপনা সরাসরি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেই করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।’

খরচ হয়েছে পুরোটাই

রাজশাহীর নয়টি উপজেলার সব কটিতে বরাদ্দের ৩ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এই টাকায় চিকিৎসক-নার্সদের খাবার, আলাদা হোটেলে চিকিৎসক-নার্সদের থাকা ও ট্রান্সপোর্ট খরচ, নমুনা সংগ্রহ, ল্যাবে পাঠানোর খরচ, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার কেনা বাবদ ব্যয় করা হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সাবেক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আল মামুন বলেন, বরাদ্দের পুরো টাকাই খরচ হয়েছে। করোনায় আক্রান্তদের খাবার, রোগী পরিবহন, নমুনা পরিবহন, চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত চিকিৎসক-নার্সদের খাওয়াদাওয়ায় এই টাকা খরচ হয়েছে।

খরচের তথ্য দিতে রাজি নন

বরাদ্দের টাকা খরচ হলেও তা কোন খাতে খরচ হয়েছে, সে বিষয়ে তথ্য দিতে রাজি নন কয়েকটি উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পাপিয়া সুলতানা বলেন, বরাদ্দের টাকা খরচ হয়েছে কি না বা কীভাবে খরচ হয়েছে, এ প্রসঙ্গে তিনি কোনো কথা বলবেন না।

টাকা বরাদ্দ ও খরচ প্রসঙ্গে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শাখাওয়াত হোসেন এবং আখাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রাশেদুর রহমান।

নতুন বরাদ্দ, কেউ পেয়েছে, কেউ পায়নি

চলতি বছরের মার্চে দেশে দ্বিতীয় দফায় করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে গত ১১ এপ্রিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ৪৮৩টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অনুকূলে ৩ লাখ টাকা করে মোট ১৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। মন্ত্রণালয়ের ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের সচিবালয় অংশের সঙ্গনিরোধক ব্যয় খাত থেকে করোনার আপদকালে ব্যয়ের জন্য এই টাকা দেওয়া হয়।

যশোরের অভয়নগর, চৌগাছা ও শার্শা—তিনটি উপজেলা কমপ্লেক্সে কথা বলে জানা যায়, দ্বিতীয় দফায় বরাদ্দ পাওয়া অর্থ করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণা (মাইকিং, প্রচারপত্র ইত্যাদি), সুরক্ষাসামগ্রী ক্রয়, নমুনা সংগ্রহের পরিবহন ব্যয় এবং করোনা রোগীদের জন্য নিযুক্ত চিকিৎসকদের আবাসনে ব্যয় করা হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায় দ্বিতীয় দফায় কোনো বরাদ্দ আসেনি। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সেলিমা আখতার বলেন, ২১ জানুয়ারি এখানে যোগদানের পর এ খাতে তিনি কোনো টাকা পাননি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক পরামর্শক মুজাহেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলা পর্যায়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া গেলে জেলা হাসপাতালগুলোতে চাপ কম থাকত। উপজেলায় অক্সিজেন সরবরাহ, অক্সিজেন মাস্ক এবং হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার ব্যবস্থা করা গেলে অনেক প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হতো। তিনি বলেন, উপজেলায় যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা খরচ করার সক্ষমতা তাঁদের থাকে না। বরাদ্দের অর্থ খরচ করতে হলেও ওপর মহলের অনুমতি লাগে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা]