বন্ধুর পথে, বন্ধুর সাথে
প্রথম আলো ১৯ বছর পূর্ণ করবে আগামীকাল, ৪ নভেম্বর। এই যাত্রাপথ সহজ ছিল না। শুরুতেই চিন্তা ছিল, সফল হতে পারব তো? লক্ষ্য ছিল, দেশের এক নম্বর পত্রিকা হতে হবে। আরেক উদ্দেশ্য ছিল নিজের আয়ে চলব। ভয় ছিল এই লক্ষ্য পূরণ হবে তো? কিন্তু নতুন ও পুরোনো সকল কর্মী, সবাই মিলে আমরা এগিয়ে গিয়েছি, সফল হয়েছি। এখন ভাবতে অবাক লাগে, ভালোও লাগে। এখন তো আরও দুটো মাসিক পত্রিকা— কিশোর আলো ও বিজ্ঞানচিন্তা প্রকাশ করছি, ত্রৈমাসিক প্রতিচিন্তা বের করছি, বিশেষ ম্যাগাজিন বের করছি, প্রতিবছর ঈদসংখ্যা বের করছি, বিশেষ দিবস উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা ছাড়াও বিশেষ বিশেষ ক্রোড়পত্র করছি। প্রথমা প্রকাশন থেকে অনেক ভালো বই বের করছি। এসবের বাইরে শিশু, কিশোর ও যুবকদের নিয়ে কত কাজ করি।
সবকিছুর পরে সংবাদ ও সংবাদপত্র প্রকাশই আমাদের মূল কাজ। প্রতিদিনের নানা ঘটনা, মানুষের দুঃখ-বেদনা, সাফল্য, নানা কিছুর উত্থান-পতনের খবরাখবর তুলে ধরাই আমাদের দায়িত্ব। এসব করতে গিয়ে প্রতিদিন মোকাবিলা করতে হয় নানা ধরনের প্রতিকূলতা। ভয়ভীতি, চাপ, হামলা-মামলা এবং বিজ্ঞাপন নিয়ে সমস্যা উপেক্ষা করেই প্রতিদিন পাঠকের সামনে নতুন ছাপা কাগজ নিয়ে হাজির হতে হয়।
এভাবেই প্রতিদিন ছাপা প্রথম আলো পড়েন ৫৩ লাখ পাঠক, আর অনলাইনে পড়েন ১২ লাখ। আর ফেসবুকের প্রথম আলো র অনুসারী ১ কোটি ২৯ লাখ। প্রথম আলো অনলাইন বাংলা ভাষায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিউজ পোর্টাল।
এত কিছু করে নিজেরাই অবাক হয়ে যাই। বিস্মিত হতে হয় সংবাদপত্র এবং সব ধরনের প্রচার ও বিনোদনমাধ্যমে ব্যাপক বিস্ময়কর পরিবর্তন দেখে। ভেবে অবাক হই, প্রায় পাঁচ দশকের সাংবাদিকতা-জীবনে এত বড় বড় পরিবর্তন দেখিনি। কখনো ভাবিনি এমন এক বিস্ময়কর সময়ে আমাদের বসবাস করতে হবে।
সাংবাদিকতার তেমন ব্যবহারিক জ্ঞান ছাড়াই ১৯৭০ সালে যুক্ত হয়েছিলাম সাপ্তাহিক একতা র সঙ্গে। নানা প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দুই দশক পর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু করি দৈনিক ভোরের কাগজ । আর ১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু হয় প্রথম আলো কে নিয়ে। কখনোই পরিষ্কার জেনে-বুঝে এসব উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হইনি। কাজ করতে করতে শিখেছি ও জেনেছি।
বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছরের সাংবাদিকতা-জীবনে উত্থান-পতন অভ্যুদয়ের মধ্যে এখনো আমরা চলেছি। বর্তমানে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের যুগে সংবাদপত্র ও প্রচারমাধ্যমসহ বিশ্বের সর্বক্ষেত্রে বড় বড় পরিবর্তনের অব্যাহত ধারার কারণে বিস্মিত হচ্ছি। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ও অগ্রগতির কারণে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-সমাজ-রাষ্ট্র—কোনো কিছুই এর বাইরে নেই। কম্পিউটারে ইন্টারনেটের সংযোগ ও ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এই ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। ল্যাপটপ থেকে ট্যাব-আইপ্যাড হয়ে স্মার্টফোনের মধ্য দিয়ে এই অগ্রগতি চলছে। স্মার্টফোন এখন যার হাতে, সারা বিশ্ব তার হাতের মুঠোয়। স্মার্টফোনের কল্যাণে জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন চলে এসেছে। দ্রুততর এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলানোটা এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ, যথেষ্ট কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুলও। আমাদের সামনে অন্য কোনো পথ নেই।
পরিবর্তনের এই স্রোতের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে বিশ্বের অনেক বড় বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় এই চিত্র কিছুটা ভিন্ন। এখানে এখনো ছাপা পত্রিকার উপস্থিতি শক্তিশালী। বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে এই চিত্রের পরিবর্তন ঘটবে। কারণ, এসব দেশে ক্রমশ ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। অনলাইনের পাঠকসংখ্যা বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ সংবাদ জানতে পারছে। টেলিভিশন তো আগেই ছিল।
বিলম্বে হলেও বাংলাদেশে এক দশক ধরে সংবাদপত্র বা প্রচারমাধ্যমে একধরনের অগ্রগতিও লক্ষ করা যাচ্ছে। আমরা এখন আগের চেয়ে অনেক সজাগ। প্রচারমাধ্যমে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ফলে দেশ-বিদেশে আমাদের ছাপা ও অনলাইনে পাঠক বাড়ছে।
অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, বর্তমানে প্রথম আলো য় আমাদের পুরো ব্যবস্থাপনাটি তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ছাপা পত্রিকার সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়ত বেশি বেশি পাঠকদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি। পাঠকই আমাদের বন্ধু, আমাদের প্রধান ভরসা। সে জন্য স্বাধীন সাংবাদিকতার পাশাপাশি অনুসন্ধানী সংবাদ ও বিশ্লেষণমূলক সংবাদের গুরুত্ব বাড়ছে। সে বিষয়ে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। শেষ বিচারে সাংবাদিকতার গুণমান বৃদ্ধিই প্রধান বিষয়। এ জন্য প্রতিনিয়ত ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশ ও অঞ্চল থেকে প্রথম আলো পাঠ করা হয়। দেশ-বিদেশ থেকে প্রতি মাসে প্রথম আলো অনলাইন দেখেন ও পড়েন ৭৮ লাখ পাঠক। এ চিত্র অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি।
তবে চ্যালেঞ্জ যত বড়ই হোক, যেহেতু সংবাদ থাকবে, সাংবাদিকতা থাকবে, প্রচারমাধ্যমও থাকবে—তা যে রূপেই হোক। তাই প্রশ্ন উঠছে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের এই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, কোন মাধ্যমে কীভাবে কত বেশি মানুষের কাছে কত দ্রুত পৌঁছানো যায়, সেই চিন্তা ও পরিকল্পনাকে আমাদের প্রাধান্য দিয়েই সামনে চলতে হবে। প্রতিবছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কাছে এলে পেছন ফিরে তাকাই। আজকের ক্রোড়পত্রে যেমন রয়েছে অনেক ‘আলোর গল্প’। এক বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা আমরা মূল্যায়ন করি। নতুন উদ্যমে বন্ধুর পথে, বন্ধুর সাথে পথচলা শুরু করি আমরা।