বছরে গর্ভপাত প্রায় ১২ লাখ
দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আরামগঞ্জ গ্রামের জুলেখা বেগম আর সন্তান নিতে চাননি। চা-বিক্রেতা স্বামী আলাউদ্দিন মৃধাকে সঙ্গে নিয়ে উপজেলা সদরে এসেছিলেন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে। দালাল তাঁদের নিয়ে যায় একটি বেসরকারি ক্লিনিকে। গর্ভপাত করাতে গিয়ে মৃত্যু হয় জুলেখার।
আলাউদ্দিন মৃধার তিন ছেলেমেয়ে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জুলেখার দুই মাসের বেশি মাসিক বন্ধ থাকায় স্বামী-স্ত্রী চিন্তিত হয়ে পড়েন। ১০ জুন কলাপাড়া সদরে আসেন। উপজেলা হাসপাতালের সামনে থেকে এক নারী তাঁদের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে যান। স্ত্রীকে ক্লিনিকে রেখে আলাউদ্দিন বাজারে গিয়েছিলেন। দুপুরের পর ফিরে এসে জানতে পারেন স্ত্রী মারা গেছেন। গর্ভপাত করাতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে জুলেখার মৃত্যু হয়। ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে ওই দিনই স্থানীয় থানায় মামলা করেন আলাউদ্দিন।
গর্ভপাত করাতে গিয়ে কত নারীর মৃত্যু হয়, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে সর্বশেষ একটি জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ২৭১টি স্বপ্রণোদিত গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাতৃ ও প্রজনন স্বাস্থ্য কর্মসূচির ব্যবস্থাপক ফাহমিদা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে গর্ভপাত বেআইনি। যাঁরা গর্ভপাত করাতে চান, তাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে কাজটি করেন। সাধারণত অদক্ষ, হাতুড়ে ডাক্তাররা এ কাজ করেন। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি।’ এই সরকারি কর্মকর্তা বলেন, দেশে মাতৃমৃত্যুর একটি কারণ অনিরাপদ গর্ভপাত।
একাধিক গবেষণা বলছে, বিশ্বব্যাপী গর্ভপাত বাড়ছে, এর একটি বড় অংশ অনিরাপদ গর্ভপাত। বাংলাদেশও এই ধারার বাইরে নয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পর্যাপ্ত পরিবার পরিকল্পনা সেবা না থাকায় বাড়ছে গর্ভধারণ ও গর্ভপাত।
দেশের আইনে গর্ভপাত দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে দণ্ডবিধিতে (ধারা ৩১২-৩১৬) বলা আছে, শুধু মায়েরজীবন রক্ষার প্রয়োজনে গর্ভপাত করানো যেতে পারে। অর্থাৎ, গর্ভধারণ অব্যাহত থাকলে যদি মায়ের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে, তাহলে মায়ের জীবন রক্ষায় গর্ভপাত করানো যায়।
কত গর্ভপাত: মায়ের স্বাস্থ্য সমস্যা থাকার কারণে কিছু গর্ভপাত আপনা আপনি হয় আর কিছু গর্ভপাত মায়ের ইচ্ছায় করানো হয়। একে বলা হয় স্বপ্রণোদিত গর্ভপাত (ইনডিউসড অ্যাবোরশন)। সর্বশেষ জরিপ (২০১৪) বলছে, দেশে বছরে ১১ লাখ ৯৪ হাজার স্বপ্রণোদিত গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ, দৈনিক গড়ে এ ধরনের গর্ভপাতের সংখ্যা ৩ হাজার ২৭১টি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গুতম্যাকার ইনস্টিটিউট ২০১৪ সালে এই জরিপ করেছিল। এই প্রতিষ্ঠান জনসংখ্যা, প্রজনন স্বাস্থ্যের মতো বিষয় নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলসহ বিশ্বের একাধিক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা করে থাকে। বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রিভেনশন অব সেপটিক অ্যাবোরশন, বাংলাদেশ (বাপসা) ২০১৪ সালের জরিপের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সম্প্রতি জরিপের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এই তথ্য এখন ব্যবহার করছে।
জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ১ হাজার নারীর মধ্যে ২৯ জন স্বপ্রণোদিত গর্ভপাত করান। এ ধরনের গর্ভপাতের হার সবচেয়ে বেশি খুলনা বিভাগে। এই বিভাগে ১ হাজার নারীর মধ্যে ৩৯ জন গর্ভপাত করান। সবচেয়ে কম চট্টগ্রাম বিভাগে। এই বিভাগে গর্ভপাতের হার ১৮।
>*অনেক নারী গর্ভপাত-পরবর্তী স্বাস্থ্য জটিলতার চিকিৎসা নেন না
*গর্ভপাতের হার খুলনা বিভাগে বেশি, চট্টগ্রামে কম
*মাসিক নিয়মিতকরণে ওষুধের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার তাগিদ
স্বপ্রণোদিত গর্ভপাতের হার বাড়ছে বলে জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। একই বয়সী নারীদের মধ্যে ২০১০ সালে গর্ভপাতের হার ছিল ১৭। অর্থাৎ, ১ হাজার নারীর মধ্যে ১৭ জন গর্ভপাত করাতেন।
জরিপে দেখা গেছে, গর্ভপাত করার পর প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন নারী গর্ভপাতজনিত স্বাস্থ্য জটিলতার শিকার হন। ২০১৪ সালে তাঁদের মোট সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লাখ ৬০ হাজার। এঁদের মধ্যে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৪০০ জনকে জটিলতার জন্য চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। অন্যরা চিকিৎসা নেননি।
হাতের কাছেই ব্যবস্থা
বরগুনা জেলা সদরে যেকোনো রিকশাচালককে বললেই ফার্মেসি পট্টিতে যাওয়া যান। অনেকগুলো ওষুধের দোকান পাশাপাশি। একাধিক সরকারি চিকিৎসক ও নারী সংগঠনের কর্মীরা বলেছেন, এখানকার একাধিক ওষুধের দোকানে গর্ভপাত করানো হয়। মূলত হাতুড়ে চিকিৎসকেরা এটা করে থাকেন।
এ রকম একজন চিকিৎসকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। ওই নারী চিকিৎসকের ভাষ্য, তিনি মাধ্যমিক পাস। তাঁর প্যারামেডিক কোর্স করা আছে। মাসিক নিয়মিতকরণ (এমআর) ও গর্ভপাত বিষয়ে তাঁর প্রশিক্ষণ আছে। গর্ভের সন্তানের আকার দেখে তিনি গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেন। মায়ের ঝুঁকি থাকলে তিনি কাজটি করেন না।
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটা যে শুধু বরগুনা শহরে হচ্ছে তা না; দেশের সব বড় ও মাঝারি শহর ও উপজেলা সদরে এ রকম ব্যবস্থা আছে। রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে বাবুবাজার এলাকার কিছু ক্লিনিকে গর্ভপাত করানো হয় বলে একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন। মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সেন্টারের আশপাশে দালালদের আনাগোনা দেখা যায়। গর্ভপাত করাতে চান এমন নারীদের জন্য এরা ওত পেতে থাকে। এরপর নিয়ে যায় আশপাশের ক্লিনিকে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাসিক নিয়মিতকরণের জন্য বাজারে এখন ওষুধ আছে। এই ওষুধ সহজে কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। অনেকেই গর্ভধারণ করছেন।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির অপূর্ণ চাহিদার (আনমেট নিড) হার ১২ শতাংশ। অর্থাৎ, পদ্ধতি গ্রহণের ইচ্ছা থাকলেও ১২ শতাংশ দম্পতি প্রয়োজনের সময় হাতের কাছে কোনো পদ্ধতি পান না। ফাহমিদা সুলতানা বলেন, ‘পদ্ধতি গ্রহণের চাহিদা পূরণ না হওয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের একটি পরিণতি গর্ভপাত।’
করণীয় কী: হাতুড়ে চিকিৎসক, কবিরাজ, অদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে গর্ভপাত করাতে গিয়ে জুলেখার মতো অনেকেরই মৃত্যু হয়। মৃত্যু না হলেও অনেকে বড় ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতায় পড়েন। এটা এখন জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে।
বিশিষ্ট প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক লতিফা শামসুদ্দিন বলেন, ‘অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ কমানোর জন্য পরিবার পরিকল্পনা বা জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা জোরদার করতে হবে। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির অপূর্ণ চাহিদা কমাতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ কম হলে গর্ভপাতও কম হবে।’
ফাহমিদা সুলতানা বলেন, মাসিক নিয়মিতকরণ ওষুধের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ওষুধের দোকানদারদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে। হাতুড়ে বা অদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে হবে।