বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী কাল, দেশে-বিদেশে হবে উদ্যাপন
করাচির কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে দেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন বিকেলে তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ থেকে বঙ্গবন্ধু নামার পর পূর্ণতা পেয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এক উৎসবমুখর পরিবেশে লাখো মানুষ বরণ করে নিয়েছিলের তাঁদের প্রিয় নেতাকে। ঐতিহাসিক সেই দিনকে বেছে নেওয়া হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকারের জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনা হিসেবে। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। বছরব্যাপী দিনটি দেশে–বিদেশে উদ্যাপন করা হবে।
২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় মুজিব বর্ষ উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত সরকার মুজিব বর্ষ উদ্যাপন করবে। দেশের ভেতর ছাড়াও বাইরে উদ্যাপিত হবে জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিব বর্ষের আনন্দ আয়োজন।
জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি হবে ১৭ মার্চ। বড় পরিসরে অনুষ্ঠানটি করার কথা থাকলেও করোনাভাইরাস বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় এখন ছোট পরিসরে অনুষ্ঠানটি উদ্যাপন করা হবে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। রাত ৮টায় বঙ্গবন্ধুর জন্মসময় অনুযায়ী আতশবাজির আয়োজন থাকবে। তবে কর্মসূচিগুলোতে জনসমাগম এড়িয়ে চলা হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেখানেই বাংলাদেশের মিশন আছে, সেখানে আমরা মুজিব বর্ষ উদ্যাপন করব। মুজিব বর্ষের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের নতুন ব্র্যান্ডিং করতে চাই। বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে একটি সম্ভাবনার দেশ হিসেবে তুলে ধরতে চাই। বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে চাই বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ।’
বিশ্বব্যাপী বছরটি নানা আয়োজনে বিভিন্ন দেশে উদ্যাপন করার সিদ্ধান্ত থাকলেও করোনাভাইরাসের কারণে দিনক্ষণে কিছুটা পরিবর্তন আসবে। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ভারত সফরে গিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছিলেন বাংলায়। এবার ভারত ও জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করা হবে।
ইউনেসকোর সদর দপ্তর প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেসকোর ৪০তম সাধারণ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যার ফলে ইউনেসকোভুক্ত বিশ্বের ১৯৫টি দেশে উদ্যাপন করা হবে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত মুজিব বর্ষের বিশ্বস্বীকৃতি দেয় ইউনেসকো। এর ফলে ইউনেসকো বা এর ১৯৫ সদস্যরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ বা দ্বিপক্ষীয়ভাবে এই দিবসটি উদ্যাপন করতে পারবে বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্মৃতি জড়িয়ে আছে—এমন শহর ছাড়াও বাংলাদেশিরা বসবাস করেন যেসব শহরে, সেসব শহরেও নানা আয়োজন করা হবে। এর মধ্যে দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, লন্ডন, সিডনি শহরে উৎসবের প্রস্তুতি আছে।
মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি (মরণোত্তর) প্রদান করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে এ ডিগ্রি প্রদান করা হবে। সংসদে বিশেষ অধিবেশন বসবে। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বছরজুড়ে চলবে নানা আয়োজন।
৭৭ মিশনে ২৬১ অনুষ্ঠান
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর পাশাপাশি দেশে সারা বছর যেসব অনুষ্ঠান হবে, তাতে বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন ভাষায় বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণ প্রকাশ ও প্রচার, বঙ্গবন্ধুর বিদেশ সফরের ওপর প্রামাণ্যচিত্র তৈরি এবং সমুদ্র বিজয়ের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের ৭৭টি দূতাবাসে ২৬১টি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত বছরজুড়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান সম্মতি জানিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ভুটানের রাজা জিগমে খেশার নামগেল ওয়াংচুক, সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ জায়েদ আল নাহিয়ান, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, ভারতের কংগ্রেসের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ প্রমুখ।
এ ছাড়া কেনেডি পরিবারের কোনো সদস্য এবং জোসেফ স্টিগলিৎজ বা জেফরি স্যাকসের মতো ব্যক্তিদের বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ আশা করা হচ্ছে।
বিভিন্ন অনুষ্ঠান
মুজিব বর্ষে ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান, জুলি ও কুরি পদকপ্রাপ্তি দিবস উদ্যাপন, সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বড় আকারে একটি অনুষ্ঠান এবং ১৯৭১ সালে যেসব ভারতীয় যোদ্ধা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে একটি প্রতিনিধিদলকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ ছাড়া দিল্লি, কলকাতা, মস্কো, ওয়াশিংটনসহ ১২টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন, লন্ডনের সংসদে একটি অনুষ্ঠান, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানেরও পরিকল্পনা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
দূতাবাসগুলো কী ধরনের অনুষ্ঠান করবে, সে ব্যাপারে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। দিল্লি, কলকাতা, লন্ডন, ভুটান, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের বিশেষ ভূমিকার কারণে ওই স্থানগুলোতে ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। ওই অনুষ্ঠানগুলোতে সেই দেশগুলোর বিশিষ্ট নাগরিকদের অংশগ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
ইউনেসকো পুরস্কার ও বঙ্গবন্ধু চেয়ার
প্যারিসে বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা এই প্রতিবেদককে জানান, বঙ্গবন্ধুর নামে একটি পুরস্কার প্রবর্তনের জন্য ইউনেসকোকে প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের জুনে ইউনেসকো বাংলাদেশের প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে। পুরস্কার প্রবর্তনের পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে বছর দুয়েক সময় প্রয়োজন। বাংলাদেশ চাইছে, আগামী বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নামে ইউনেসকোর পুরস্কারটি চালু হোক।
বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে গবেষণার জন্য এরই মধ্যে ভারত, থাইল্যান্ড ও পোল্যান্ডে বঙ্গবন্ধু চেয়ার আছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ও কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু সেন্টার স্থাপনের আলোচনা চলছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশন দেশের সব মসজিদে দোয়া মাহফিল আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছে।