ফ্ল্যাট প্রতারণা-ভূমি জালিয়াতির শাস্তি দ্রুত নিশ্চিতে আইন হচ্ছে

কানিজ ফাতেমা নিজের নামে ফ্ল্যাট কেনার জন্য একটি আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে চুক্তি মোতাবেক ৮৪ লাখ টাকা জমা দেন ২০১৭ সালে। শেষ কিস্তি ছিল সাত লাখ টাকা। সেই কিস্তি দিতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি তাঁর মা অসুস্থসহ নানা টালবাহানা করতে থাকেন। পরে কানিজ ফাতেমা কিস্তির টাকা ঠিক সময়ে পরিশোধ করেননি অভিযোগ তুলে উল্টো মামলা ঠুকে দেন তিনি। কানিজ ফাতেমাও ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরে ওই ব্যক্তি টাকা ফেরত দিতে রাজি হয়ে চেক দেন। কিন্তু সে চেকের অ্যাকাউন্টে টাকা ছিল না। দেড় বছর ধরে এই চেক জালিয়াতির মামলাও চলছে।

থানা-পুলিশ আর আদালতে দৌড়াদৌড়ির ভোগান্তি নিয়ে কানিজ ফাতেমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজধানীর ধানমন্ডি থানাসহ বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপিদের কাছে যেতে হচ্ছে। ফ্ল্যাট বা টাকা কোনোটাই পাচ্ছি না। আমাদের কাছে ফ্ল্যাটের টাকা নিলেও শুনেছি, ওই একই ফ্ল্যাট অন্য একজনের কাছেও বিক্রি করা হয়েছে। আমার স্বামী বিদেশে থাকেন। চুক্তিপত্রসহ সব কাগজ নিয়ে একা একা দৌড়াতে হচ্ছে বছরের পর বছর।’

কানিজ ফাতেমাদের মতো যাঁরা জালিয়াতির শিকার হচ্ছেন, তাঁদের ভোগান্তি কমাতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। ফ্ল্যাট কেনার পরও তা হস্তান্তর না করা, দলিলের মাধ্যমে যেকোনো জমি নিয়ে জালিয়াতি, অবৈধভাবে খাসজমি দখলসহ এ ধরনের অপরাধের শাস্তি দ্রুত নিশ্চিতে ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২১ শিরোনামে আইনের প্রাথমিক খসড়া করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এতে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা জরিমানাসহ বিভিন্ন শাস্তির বিধান রাখা হচ্ছে। আইনটির কিছু ধারা জামিনযোগ্য আবার কয়েকটি ধারা জামিন–অযোগ্য। জনগণের মতামত জানার জন্য খসড়াটি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে।

আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন সাজাপ্রাপ্ত হলে এবং পরবর্তী সময়ে একই অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। যেকোনো অপরাধের ক্ষেত্রে সহায়তাকারীও অভিযুক্ত ব্যক্তির মতোই দণ্ডপ্রাপ্ত হবেন। আইনটির কোনো অপরাধ সম্পর্কে মামলা বা অভিযোগ দায়ের, তদন্ত, বিচার ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানাবলি প্রযোজ্য হবে। এই আইনের অধীন অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ধারণ করা ছবি, ভিডিও, অডিও ইত্যাদিও সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে।

আইনের খসড়া অনুযায়ী ব্যক্তিমালিকানাধীন বা সরকারি খাসজমিসহ সরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার মালিকানাধীন ভূমির স্বত্ব ও দখলভোগ, ভূমিলিপ্সু কোনো ব্যক্তির জালিয়াতি বা প্রতারণামূলক ও অন্যের যোগসাজশে দলিলমূলে বা কোনো দলিল ছাড়াই বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না নিয়ে অবৈধভাবে ভূমির দখল, দখলের চেষ্টা বা তার ক্ষতি করা এবং কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পেশিশক্তি ও দেশীয় বা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্যই এ ধরনের একটি আইন করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, দেশে বিদ্যমান আইনে জাল দলিলের মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর করা, চুক্তি অনুযায়ী দখল না বুঝে পাওয়ার ক্ষেত্রে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীকে ‘রাইট অ্যান্ড টাইটেল’ রক্ষা করতে দেওয়ানি এবং জালজালিয়াতি ও প্রতারণার জন্য ফৌজদারি আদালতে মামলা করতে হয়। নতুন আইনে দেওয়ানি প্রতিকারের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি। তবে এ আইনে প্রতারণা ও জালজালিয়াতি এবং চুক্তিভঙ্গের মতো অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ বা ভুক্তভোগীরা উপকৃত হবেন।

খসড়া বলছে, ভূমিতে মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, ভূমিসম্পর্কিত দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলাজট কমানো, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যাতে তার জমিতে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে—এসবও আইন প্রণয়নে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আইনের অধীন যেকোনো অপরাধের প্রতিকার চেয়ে ভূমিসংশ্লিষ্ট থানা বা উপযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করা যাবে। আইনটিতে আদালতের বিবেচনায় বিচারপ্রার্থী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া, ক্ষতিপূরণের অংশবিশেষ সরকারি তহবিলে জমা দেওয়া, সাক্ষীর সুরক্ষা এবং ভূসম্পদ সুরক্ষায় কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

বিভিন্ন অপরাধে শাস্তির বিধান

আইনের খসড়ায় আবাসন ব্যবসা, মাটি ভরাট, বালু উত্তোলন, পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপন, জাল দলিলসংক্রান্ত অপরাধ ও জালিয়াতি, উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে বেশি জমি নিজ নামে দলিল করা এবং উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করতে জমি বিক্রির জন্য দলিল করাসহ বিভিন্ন অপরাধে শাস্তির বিষয়টি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, যদি কোনো রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার বা তার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একটি জমি একাধিক ব্যক্তির নামে দলিল করে দেন, চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পাওয়ার পর ঘোষণা দেওয়া সময়ের মধ্যে জমির দখল হস্তান্তর করতে ব্যর্থ হন বা ফ্ল্যাট বিক্রির পর ঘোষিত সময়ের মধ্যে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করতে ব্যর্থ হন বা ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হলেও ফ্ল্যাটের দলিল হস্তান্তর করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তিনি সর্বোচ্চ ২ বছরের এবং সর্বনিম্ন ৬ মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা এবং সর্বনিম্ন ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

ভূমির মালিকের সঙ্গে কোনো ডেভেলপার কোনো রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর চুক্তির শর্ত অনুযায়ী রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন যথাযথভাবে সম্পন্ন করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভূমির মালিকের অংশ ভূমির মালিকের কাছে হস্তান্তর না করলে বা দখল বুঝিয়ে না দিলে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড অথবা ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

এ আইন প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আইন ২) মো. খলিলুর রহমান বলেন, আইনটির খসড়া তৈরির আগে মাঠপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নেওয়া হয়েছে। আর এখন যেসব মতামত পাওয়া যাবে, সেগুলোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বসে আলোচনার মাধ্যমেই আইনের খসড়া চূড়ান্ত হবে।

সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ

বর্তমানে ২০১০ সালের রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইনে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে। তবে আইনটিতে জালজালিয়াতি নিয়ে সরাসরি বা স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন প্রথম আলোকে বলেন, আইনটি হতে হবে ব্যবসাবান্ধব। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা দুই পক্ষের বিষয়গুলোই গুরুত্ব পেতে হবে। ক্রেতা চুক্তি ভঙ্গ করলে তাঁর জন্যও শাস্তির বিধান রাখতে হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, আইনের খসড়ায় ভূমিদস্যু শব্দটিকে এড়িয়ে ভূমিলিপ্সু বলা হয়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে সরকার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি নজরে এনে একটি আইন করতে যাচ্ছে, তা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান খসড়া আইনের বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, একক বা দলগতভাবে অবৈধভাবে ভূমির দখল, বেআইনি দখল বজায় রাখতে দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন ও ব্যবহার করে প্রাণনাশের হুমকি, বৈধ কাগজপত্র না থাকার পরও ব্যক্তিমালিকানাধীন বা সরকারি খাসভূমিসহ সরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার মালিকানাধীন ভূমি জোরপূর্বক দখল অথবা ভূমির জোরপূর্বক দখল অব্যাহত রাখার মতো বিষয়গুলোতে আইনের বিভিন্ন ধারায় অপরাধ হিসেবে গণ্য করে শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এসব ধারায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো তাদের ভূমির অধিকার না পাওয়া পর্যন্ত এসব ধারার আওতায় পড়বে না, তা উল্লেখ করা হয়নি। ফলে খুব সহজেই এই গোষ্ঠীকে অপরাধী প্রমাণ করা যাবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এই আইনের অধীন করা মামলা যেকোনো পর্যায়ে পক্ষগুলোর সম্মতিতে আদালতের বাইরে অথবা আদালতে আপসের সুযোগ রাখা হয়েছে। এটা বাতিলের দাবি জানিয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ভূমিদস্যুরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী পক্ষকে আপস করতে বাধ্য করে। ভূমিদস্যুতার পেছনে দায়ী সরকারি কর্মকর্তাদের কঠোর শাস্তির বিধান রাখার ওপরও গুরুত্ব দেন এই পরিবেশ আইনজীবী।