ফুল, পাতা, ভেষজের পানীয় দেবে চায়ের মতো সতেজতা
শীতের হিমেল হাওয়ায় বসে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা কার না ভালো লাগে। এই চায়ের মূল উপাদান চা-পাতা। টি-ব্যাগের চা খাওয়ার অভ্যাসও অনেকের আছে। তবে চা-পাতার বাইরে অন্যান্য পাতা, ফুল ও ফলের গুঁড়া দিয়ে তৈরি ‘গ্রিন টি’-এর কথা হয়তো কম লোকই শুনেছেন। এখন এটাও পাওয়া যাচ্ছে দেশে।
শজনে ও পাটপাতা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে এই পানীয়ের উপাদান। আর ফুলের মধ্যে ক্যামোমিল ও পার্সলি ফুল ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া আমলকী, হরীতকী ও বহেড়া—এই তিনের মিশ্রণে তৈরি হচ্ছে ‘ত্রিফলা’। চায়ের মতো সতেজতা আনার এই পানীয়র উপকরণ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন দুই বন্ধু—আদনান বাবু ও জাকির হোসেন তপু। মহিমা প্রোডাক্টস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান তাঁরা।
এর মধ্যে পাটপাতার গ্রিন টি সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ ২৬) পৌঁছে গেছে। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় ২০০ প্যাকেট নিয়ে গেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের এর সঙ্গে পরিচিত করাতে।
২০১৬ সাল থেকে পাটপাতার এই গ্রিন টি উৎপাদন শুরু হলেও, অন্য চারটি—শজনেপাতা, ক্যামোমিল, পার্সলি ও ত্রিফলার উৎপাদন শুরু হয় মহিমা প্রোডাক্টসের জন্মের শুরু থেকে। ২০০৪ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।
টাঙ্গাইলের ধলেশ্বরী নদীর তীরে ৩০ শতাংশ জমির ওপর তৈরি কারখানাটি। সেখানেই ২৬ জন কর্মীর শ্রমে উৎপাদিত হয় বিশেষ পানীয়র এসব উপকরণ।
মহিমা প্রোডাক্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সংগীতশিল্পী আদনান বাবু প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষকে ব্যতিক্রমী পণ্য ব্যবহার করানো, যেসব প্রাকৃতিক জিনিস মানুষ ব্যবহার করে না, সেসব ব্যবহার করানোর তাগাদা থেকে এসব চা উৎপাদন শুরু করি।’
এগুলো বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়। এর মধ্যে পার্সলির দাম সবচেয়ে বেশি, ৩০টি টি-ব্যাগের প্রতি প্যাকেট ৫০০ টাকা। এরপরেই রয়েছে ক্যামোমিল, দাম ৪০০ টাকা। এ ছাড়া ত্রিফলার প্যাকেটের দাম ৩০০ টাকা, শজনেপাতা ৩৭৫ টাকা ও পাটপাতা ২০০ টাকা। দেশে লাজফার্মাসহ মণিপুরিপাড়ার জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারে (জেডিপিসি) এগুলো পাওয়া যায়।
আদনান বাবু বলেছেন, বর্তমানে দেশে তাঁদের এই চায়ের ১২ থেকে ১৪ হাজার প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে। তাঁরা আরও অনেক বেশি বাজারজাত করতে পারেন।
‘পাটপাতার চা’
২০১৬ সালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট পাটপাতার ‘অর্গানিক চা’ উদ্ভাবনের দাবি করে। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় গুয়ার্ছি অ্যাকুয়া অ্যাগ্রোটেক নামের একটি প্রতিষ্ঠান তা জার্মানিতে রপ্তানি করে। পাট মন্ত্রণালয় এই প্রতিষ্ঠানকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এনে মালিক এইচ এম ইসমাইল খানকে পাটপাতার চা প্রকল্পের উপদেষ্টা করে। বিজেএমসি সূত্রে জানা যায়, সেই প্রকল্পে তখন ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৫ কোটি টাকা। তবে এই প্রকল্প পরে আর এগোয়নি। এ ছাড়া বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) পাটপাতার চা উৎপাদন করত। তবে তা এখন বন্ধ।
বর্তমানে শুধু মহিমা প্রোডাক্টস তৈরি করছে পাটপাতার চা। একেবারে দেশীয় পাট থেকে তা উৎপাদিত হয় বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। উদ্যোক্তারা বলেন, পাটপাতা মূলত সংগ্রহ করা হয় টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও জামালপুর থেকে।
প্রতিবছর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে সংগ্রহ করা হয় এসব পাটপাতা। সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে বছরে ৫০ কেজির মতো পাতা সংগ্রহ করা হয় বলে জানান আদনান বাবু। এরপর রোদে শুকিয়ে সেগুলো সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে মেশিনে কুচিকুচি করে কেটে তা টি-ব্যাগে ভরে বাজারজাত করা হয়।
শজনেপাতার চায়ের চাহিদা ৩ হাজার প্যাকেট
পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে শজনেপাতার। অনেকে শজনেপাতা শুকিয়ে গুঁড়া করে তা পানিতে ভিজিয়ে খান। ওই চিন্তা থেকে শজনেপাতার গুঁড়া টি-ব্যাগে ভরে বাজারে এনেছে মহিমা প্রোডাক্টস। এর চাহিদা মাসে ৩ হাজার প্যাকেটের মতো বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
আদনান বাবু বলেন, দেশের শ খানেক কৃষকের কাছ থেকে শজনেপাতা সংগ্রহ করা হয়। মূলত টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও জামালপুর থেকেই এগুলো আনা হয়। সংগৃহীত ২০ কেজির মতো শুকনা পাতা মজুত করা হয়। পাতা পরিপক্ব হয়ে ঝরে যাওয়ার আগেই সংগ্রহ করা হয়।
বাকিগুলো শৌখিন ‘চা’
আদনান বাবু বলেন, ক্যামোমিল, পার্সলি ও ত্রিফলার উৎপাদন মূলত শৌখিন পণ্য হিসেবে। বিশেষ করে ক্যামোমিল ও পার্সলির দাম বেশি বলে উৎপাদন হয় কম। দুটি মিলিয়ে মাসে দেড় থেকে দুই হাজার প্যাকেট উৎপাদন করা হয়। এগুলো আবার আমদানি করতে হয় ইউরোপ থেকে।
অন্যদিকে আমলকী, হরীতকী ও বহেড়ার সংমিশ্রণে তৈরি ত্রিফলার চাহিদা কিছুটা বেশি। মাসে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার প্যাকেটের মতো।
মহিমা প্রোডাক্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ত্রিফলা মূলত লিভার পরিশোধক হিসেবে কাজ করে। আমলকী, হরীতকী, বহেড়া অনেকে সকালে এমনিতেই খান। তাই মানুষের কষ্ট কমাতে সব কটি মিশ্রণ করে টি-ব্যাগে আনার চিন্তা থেকেই এ উদ্যোগ।