ফিরে দেখা : ২১–এর আলোচিত ২১

বিদায়ী ২০২১ সালকে মনে রাখার অন্তত ২১টি কারণ তো আছেই। তালিকা এর চেয়ে লম্বাও হতে পারে। তবে বছরটির সঙ্গে মিলিয়ে ২১টি আলোচিত ঘটনার বিশ্লেষণ করাই যায়।

বিদায়ী ২০২১ সালকে মানুষ কেন মনে রাখবে। প্রথম কারণ, ২০২০ সাল যে একটি বিষময় বছর ছিল, সেখান থেকে মুক্তি দিয়েছিল ২০২১। করোনার টিকা আবিষ্কৃত হলেও বাংলাদেশে তা তখনো আসেনি। ২০২১ সালে সবার চাওয়াই ছিল করোনার টিকা। টিকার সঙ্গে টাকার যোগাযোগ আছে। টিকা আনতে টাকা লেগেছে, আবার কারও কারও জন্য টিকা টাকাও নিয়ে এসেছে। সব অর্থেই ২০২১ সালের আলোচিত বিষয় ছিল টিকা ও টাকা।

তবে ২০২১ সালকে মানুষের মনে রাখার আরও অনেক কারণ আছে। গুনে গুনে এ রকম ২১টি কারণও বের করা যায়। এ জন্য একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে। যদিও শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘যেতে-যেতে’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘যাবেই যদি ঘন-ঘন পেছন ফিরে তাকানো কেন?’ উত্তরটিও দিয়েছিলেন কবি, ‘যাত্রী তুমি, পথে-বিপথে সবেতেই তোমার টান থাকবে/ এই তো চাই—’। তাহলে তো ২০২১ সালের আলোচিত একুশের দিকে তাকানোই যায়।

১. আলোচিত অর্জন: আর নয় এলডিসি

এই ভালো খবর বিদায়ী বছরে দুবার এসেছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় ঢুকেছিল ১৯৭৫ সালে। এরপর ২০১৮ সালে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রাথমিক সুপারিশ পায় বাংলাদেশ। আর চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করে। এরপর গত ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশ সম্পর্কে সিডিপির সুপারিশ গ্রহণ করে। এর ফলে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে পুরোপুরি বের হয়ে যাবে বাংলাদেশ।

২. আলোচিত ভাই: আবদুল কাদের মির্জা

বছর যখন শুরু হয়, তখন চলছিল পৌরসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচনের সহিংসতা বা অনিয়ম নিয়ে লেখালেখি হয়েছেও প্রচুর। আবার সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছিলেন কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভার মেয়র প্রার্থী আবদুল কাদের মির্জা। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করা ছিল তাঁর প্রথম আলোচিত কর্মকাণ্ড। এরপর তিনি দল, দলের নেতা, নির্বাচনের অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ নানা বিষয়ে ক্রমাগত কথা বলে গেছেন। আর বছর শেষে কেবল যে তাঁর মুখ চলেছে তা নয়, হাত-পাও সমানে চলেছে।

আবদুল কাদের মির্জা
ফাইল ছবি

সম্ভবত এটি রুশ কৌতুক। তা হলো বন্ধু বেছে নেওয়া যায়, কিন্তু ভাই বেছে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ভাই অনিবার্য। কৌতুকটা হাড়ে হাড়ে টেন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কারণ, বছরজুড়ে তাঁকে বিব্রত করা আবদুল কাদের মির্জা ওবায়দুল কাদেরেরই ছোট ভাই।

৩. আলোচিত পতন: ইভ্যালি

ইভ্যালির পতনের সঙ্গে অন্য যেকোনো পতনের তুলনা করা কঠিন। কারণ, ইভ্যালি যে কেবল নিজে ডুবেছে তাই নয়, পুরো ই-কমার্স খাত নিয়ে ডুবেছে। আর সেই সঙ্গে লাখ লাখ গ্রাহকও হারিয়েছেন সব অর্থ। এমনকি ইভ্যালির পতন থেকে রক্ষা পাননি তারকারাও।

তাহসান, মিথিলা ও শবনম ফারিয়া
ফাইল ছবি

তাহসান খান, মিথিলা ও শবনম ফারিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন গ্রাহকেরা। আবার অর্থ আত্মসাতের ইভ্যালি মডেল ছড়িয়ে পড়েছিল ই কমার্স খাতে। ফলে সব মিলিয়ে ইভ্যালি বছরের আলোচিত পতনেরই আরেক নাম।

৪. আলোচিত সাফল্য: নারী ফুটবল ও ক্রিকেট

২০২১ সালের আলোচিত হতাশার নাম যদি হয় ছেলেদের ক্রিকেট ও ফুটবল, তাহলে আলোচিত সাফল্যের নাম মেয়েদের ফুটবল ও ক্রিকেট। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটের ভরাডুবি হয়েছে। অন্যদিকে ছেলেদের ফুটবল নিয়ে আলোচনা যত কম করা যায়, ততই ভালো।

ভারতকে হারিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ
ফাইল ছবি

অন্যদিকে এবার প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেট ফেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে নারী ক্রিকেট দল। তবে বছর শেষে উদ্বেলিত করেছে অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবল দল। ভারতকে হারিয়ে তারা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ।

৫. আলোচিত বহিষ্কার: গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় গত ১৯ নভেম্বর। মূলত গোপনে ধারণ করা তাঁর কথোপকথনের একটি ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন। বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনার পরে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। এরপর মেয়রের পদ থেকেও তাঁকে বরখাস্ত করা হয়।

জাহাঙ্গীর আলম
প্রথম আলো ফাইল ছবি

এর আগে গত জুনে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে টাঙ্গাইলের প্যানেল মেয়র হাফিজুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপন নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করা রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলীকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এই ডিসেম্বরেই। আবার এ মাসেই শিক্ষা কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করায় জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভার মেয়র শাহনেওয়াজ শাহানশাহকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

৬. আলোচিত ভ্রমণ-মুরাদ হাসানের বিমানবন্দর সফর

সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রীকে বিদায়ী বছরে অনেকগুলো কারণে আলোচিত চরিত্রের তালিকায় রাখা যায়। মন্ত্রী হয়েও প্রকাশ অযোগ্য যেসব কথাবার্তা প্রকাশ্যে বলেছেন, তা বিস্ময়কর। একই বিস্ময় প্রকাশ করা যায় তার ফাঁস হওয়া ফোনালাপ শুনলেও। এরপর মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। ঘটনা এখানেই শেষ ছিল না। পদত্যাগ করে এরপর মুরাদ হাসান রওনা দেন কানাডায়। সেই ভ্রমণটাই আসলে সবচেয়ে বেশি চমকপ্রদ।

দেশে ফিরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল দিয়ে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন মুরাদ হাসান
ছবি: সংগৃহীত

কানাডা সরকার ঢুকতে না দেওয়ায় সেখানকার বিমানবন্দর থাকতে হয়। সেখান থেকে চলে থেকে যান দুবাইতে। সেখানেও রাত কাটাতে হয় বিমানবন্দরেই। ফলে দেশে ফিরে আসা ছাড়া আর উপায় ছিল না। তবে ঢাকা ফিরে তাঁকে বিমানবন্দর ত্যাগ করতে হয় মুখ লুকিয়ে।

৭. আলোচিত দলবদল: মেসির সমর্থকেরা

২১ বছর বার্সেলোনায় খেলে ক্লাব বদল করেছেন লিওনেল মেসি। রেকর্ডসংখ্যক সাতবার ব্যালন ডি’অর জয়ী মেসির ক্লাব বদলের কাহিনি সবারই জানা। বাংলাদেশেও মেসির অগণিত ভক্ত। মেসির কারণে তাঁরা ছিলেন স্পেনের বার্সেলোনারও ভক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের বিরাটসংখ্যক বার্সেলোনা সমর্থক এবার মেসির সঙ্গে সঙ্গে ক্লাবও বদলে ফেলেছেন। রাস্তাঘাটে পিএসজির ৩০ নম্বর জার্সি পড়া মেসিভক্ত অসংখ্য। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে পিএসজির এই জার্সি। অন্যদিকে বার্সেলোনার নতুন জার্সি পরা কাউকে খুঁজে পাওয়াটাই এখন কঠিন। ফলে বলা যায় এ বছরের আলোচিত দলবদলের মেসি ভক্তরাই।

বার্সেলোনা ছেড়ে মেসি এখন পিএসজির
টুইটার ফাইল ছবি

৮. আলোচিত আটক: চিত্রনায়িকা পরীমনি

বছরের সালতামামি লিখতে গেলে পরীমনিকে উপেক্ষা করাই যাবে না। বহুল আলোচিত বোট ক্লাবে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ তুলেছিলেন পরীমনি নিজেই। ঘটনাটি গত জুন মাসের। সেই অভিযোগের নিষ্পত্তি না হতেই আগস্ট মাসে নিজেই গ্রেপ্তার হন পরীমনি। সেই গ্রেপ্তার অভিযানও ছিল চমকে ভরা। সে সময় করা ফেসবুকে লাইভ দেখেছেন কোটি কোটি মানুষ। পরে এক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর ভিডিও ফাঁস ও মামলার তদন্তে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার আকস্মিক বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া নিয়েও কম আলোচনা হয়নি।

জামিনে মুক্তি হয়ে পরীমনি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঘটনা সেখানেই শেষ ছিল না। বিশেষ করে নিম্ন আদালতে যেভাবে তাঁকে দফায় দফায় রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন মঞ্জুর হয়েছে, তাতে শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয় উচ্চ আদালতকে। এ প্রসঙ্গে হাইকোর্টের বক্তব্য ছিল, ‘চাইলেন আর মঞ্জুর করলেন, এগুলো সভ্য সমাজে হতে পারে না’।আবার জামিন পাওয়ার পরে যেভাবে পরীমনি হাতের মেহেদিতে নানা ধরনের বার্তা দেওয়া চেষ্টা করেছেন, এ নিয়েও চর্চা হবে বহুদিন।

৯. আলোচিত ভবঘুরে: ইকবাল হোসেন

শারদীয় দুর্গাপূজার মহা অষ্টমীর দিন ভোরে কুমিল্লা শহরের নানুয়া দিঘির উত্তর পাড়ের এক অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনায় মণ্ডপে হামলা চালায় একদল লোক। এরপর মন্দিরে-মণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটে আরও অনেক জায়গায়। সিসি ক্যামেরার সূত্র ধরে কে পবিত্র কোরআন রেখেছে, তা চিহ্নিত হয় এবং কক্সবাজারে অভিযুক্ত ব্যক্তি ধরাও পড়েন। অভিযুক্ত ইকবাল হোসেনের পরিচয় তিনি একজন ভবঘুরে। সব মহল থেকে এই পরিচয়ই দেওয়া হয়। এরপর দুই মাসের বেশি সময় চলে গেছে। এখনো তাঁর পরিচয় ভবঘুরে। এখনো কেউ জানেন না ইকবাল হোসেন কী কারণে বা কার ইশারায় কাজটি করেছিলেন।

১০. আলোচিত সাংসদ: কাজী শহিদ ইসলাম

অনেকেই অন্য দেশ বা সংস্থা থেকে নানা ধরনের স্বীকৃতি পেয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেন। কিন্তু বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাংসদ কাজী শহিদ ইসলাম দেশের জন্য নিয়ে এসেছেন আন্তর্জাতিক কুখ্যাতি। অর্থ ও মানব পাচারের মামলায় কুয়েতের একটি আদালত তাঁকে কারাদণ্ড ও জরিমানা করেছে। এর আগে অর্থ ব্যয় করে কীভাবে সংসদ সদস্য হওয়া যায়, তারও অন্যতম উদাহরণ তৈরি করেছিলেন কাজী শহিদ ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী সেলিনা ইসলাম। কারা আসলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে, তারও একটি উদাহরণ সাবেক সাংসদ কাজী শহিদ ইসলাম।

১১. আলোচিত উপহার: গৃহহীনের জন্য ঘর

মুজিব বর্ষ উপলক্ষে লক্ষাধিক গৃহহীন মানুষকে ঘর উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের এ প্রশংসনীয় উদ্যোগটিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় বিদায়ী বছরে। বিশেষ করে প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকের দুর্নীতি, অবহেলা ও অনিয়মের কারণে কার্যক্রমটি নিয়ে সমালোচনা হয়। অনেক ঘরই ধসে পড়ে। অনেক ঘরের মান ছিল খারাপ। ঘর পাইয়ে দিতে দুর্নীতির আশ্রয়ও নেওয়া হয়। ফলে সরকার কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করে। তবে প্রধানমন্ত্রীর নেওয়া একটি বিশেষ প্রকল্প নিয়েও যে ধরনের দুর্নীতি ঘটেছে, অন্য প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে কি সেটিই বিদায়ী বছরে দেশবাসীকে অনুমান করে নিতে হয়েছে।

১২. আলোচিত অক্ষর: ‘ব’

মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রধানমন্ত্রী যখন শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছিলেন, তখন সবারই চোখ যায় মূল মঞ্চের ডায়াসের দিকে। সেখানে ‘মুজিব বর্ষের’ পরিবর্তে লেখা ছিল ‘মুজিবর্ষের’। তখন থেকেই আলোচনা কোথায় গেল ‘ব’। আয়োজন কমিটির অবশ্য পরে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে, তবে তার অর্থ বের করতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে বলে তা আর এখানে উল্লেখ করা গেল না।

১৩. আলোচিত শব্দ: মানবিক বিয়ে

তাহলে বছরের আলোচিত শব্দ কী? বিদায়ী বছরে দেশবাসী অবশ্য নতুন দুটি শব্দ পেয়েছে। আর তা হলো মানবিক বিয়ে। কথাটা বলেছিলেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের একটি রিসোর্টে অবরুদ্ধ হলে সঙ্গে থাকা নারীকে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি করেছিলেন তিনি, যাঁকে গোপনে বিয়ে করেছিলেন। যদিও নিজের প্রকৃত স্ত্রী–ও তা জানতেন না। এরপর তিনি ফেসবুকে এক স্ট্যাটাস দিয়ে গোপন এই বিয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। আর সেই স্ট্যাটাসের শিরোনামই ছিল, ‘একটি মানবিক বিয়ের গল্প’।

মামুনুল হক
ফাইল ছবি

ফেসবুকবাসী অবশ্য অবরুদ্ধ অবস্থায় নিজের প্রকৃত স্ত্রীকে ফোনে বলা একটি কথাকে বছরের সেরা উক্তি বলে ঘোষণাই দিয়ে রেখেছেন। মামুনুল হকের সেই উক্তিটি হচ্ছে, ‘তুমি আবার মাঝখান দিয়া অন্য কিছু মনে কইরো না।’

১৪. আলোচিত চাপ: হেফাজতে ইসলাম

গত ২২ এপ্রিল হেফাজতে ইসলাম নিয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘চাপে, বিতর্কে অনেকটা দিশেহারা হেফাজত’। ২০১৩ সালে ঢাকা অবরোধ ও সমাবেশ করে প্রথম আলোচনায় এসেছিল হেফাজতে ইসলাম। সেই ঘটনা সামাল দেওয়া হলেও হেফাজতের সঙ্গে একধরনের আঁতাত নিয়ে আলোচনা ছিল প্রচুর। বিশেষ তাদের অনেক দাবি মেনে নেওয়ার ঘটনা নিয়েও ছিল মানুষের নানা ধরনের সন্দেহ।

সেই হেফাজতই বড় ধরনের চাপে পড়ে ২০২১ সালে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতার অংশ হিসেবে তারা গত মার্চে দেশজুড়ে সহিংসতা চালায়। ব্যাপক সহিংসতার পর গ্রেপ্তার অভিযান এবং নতুন-পুরোনো মামলায় নেতাদের গ্রেপ্তার, মামুনুল হক নিয়ে বিতর্কসহ নানামুখী চাপে দিশেহারা অবস্থায় পড়ে যায় হেফাজতে ইসলাম।

১৫. আলোচিত প্রামাণ্যচিত্র: অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার মেন

কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা গত ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নিয়ে এক অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্র বা প্রতিবেদন প্রচার করে। ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার মেন’ নামের সেই প্রামাণ্যচিত্রে মূলত তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। ব্যাপক আলোচিত এই প্রামাণ্যচিত্রটি প্রচারিত হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার থেকে এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। তবে সেনাপ্রধান নিয়ে এ ধরনের প্রতিবেদন ৫০ বছরের বাংলাদেশের জন্যও ছিল একটি নতুন অভিজ্ঞতা।

১৬. আলোচিত পর্যবেক্ষণ: ৭২ ঘণ্টার পরে ধর্ষণ মামলা নয়

ঢাকার বনানীতে রেইনট্রি হোটেলে চার বছর আগে দুজন তরুণীকে ধর্ষণের মামলা ছিল বহু আলোচিত। সেই মামলার রায় দেওয়া হয় গত ১১ নভেম্বর। রায়ে অভিযুক্ত আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচজন আসামিকেই খালাস দেন ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার।

প্রতীকী ছবি

ঝামেলা দেখা দেয় বিচারকের একটি বক্তব্য নিয়ে। বিচারক মৌখিক রায়ে পুলিশকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে যেন মামলা না নেওয়া হয়। এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। আইনমন্ত্রীও এই বক্তব্যকে অসাংবিধানিক ও বেআইনি বলে উল্লেখ করেছিলেন। পরে তাঁর বিচারিক ক্ষমতাই প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

১৭. আলোচিত কণ্ঠরোধ: রোজিনা ইসলামকে আটক

স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। এমনকি মতপ্রকাশে বাধা দিতে আইনও করা হয়েছে। তবে বিদায়ী সালে সাম্প্রতিক অতীতের অনেক কিছুই ছাড়িয়ে গেছে অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে আটক, মামলা ও জেলে নেওয়ার ঘটনায়। ১৭ মে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ৫ ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তা করা হয় তাঁকে। কেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে? কারণ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখেছিলেন রোজিনা ইসলাম। ফলে তাঁর কণ্ঠরোধ দরকার হয়ে পড়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের।

আদালতে সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম
ফাইল ছবি

আবার বিদায়ী বছরটিতেই কথা বলার শাস্তি হিসেবে না ফেরার দেশে চলে গেছেন লেখক মুশতাক আহেমদ। কারাগারেই মৃত্যু হয় তাঁর। আর মুশতাক আহমদের সঙ্গে আটক কার্টুনিস্ট কিশোর এখন জামিনে মুক্ত আছেন।

১৮. আলোচিত পিকনিক: বিনিয়োগের রোড শো

রোড শো বা বিনিয়োগ সম্মেলনটির একটা গালভরা নাম ছিল, দ্য রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশে বিনিয়োগে বিদেশিদের আকৃষ্ট করা। রোড শোর শুরু ছিল দুবাই থেকে। এরপর তা হয়েছে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি, লস অ্যাঞ্জেলেস ও সিলিকন ভ্যালিতে, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা ও জুরিখে এবং যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ও লন্ডনে। বিশাল বহর নিয়ে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের আয়োজক ছিল শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

বিশ্বব্যাপী করোনার সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে বিমান চলাচল অনেকটা সহজ হয়। ফলে অনেকেই আগ্রহ ছিল বিদেশ ঘুরে আসার। এ রকম এক সময়ে দলবল নিয়ে বিশ্বের বড় বড় শহরে বিনিয়োগ সম্মেলনকে ‘ইন্টারন্যাশনাল পিকনিক’ বলেছেন অনেকেই। এতে ব্যয় হয়েছে অনেক, তবে বিনিয়োগ কতটা এসেছে সেটাই বড় প্রশ্ন।

১৯. আলোচিত আগুন: নিত্যপণ্যের বাজার

ধরতে গেলে চালের দাম বছরজুড়েই ছিল বেশ চড়া। চালের দাম নিয়ে সারা বছরই সীমিত আয়ের মানুষকে হিমশিম খেতে হয়েছে। আবার বছরের শেষের দিকে জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে বাড়ানো হয় ২৩ শতাংশ। এর প্রভাবে বৃদ্ধি পায় পরিবহন ভাড়া। এরপর আরেক দফা দাম বাড়ে নিত্যপণ্যসহ প্রায় সবকিছুরই। কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপীই অর্থনীতিতে বছরের আলোচিত সূচক ছিল মূল্যস্ফীতি, যা নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কা আছে ২০২২ সাল ঘিরেও।

২০. আলোচিত নিষেধাজ্ঞা: র‍্যাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ

১০ ডিসেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। আর ওই দিনই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে র‍্যাবের সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ রয়েছেন। বিদায়ী বছরটিতে তো অবশ্যই, গত ৫০ বছরেই এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ বাংলাদেশের জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা।

২১. আলোচিত উপেক্ষা: গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ না পাওয়া

বাংলাদেশের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক খুব বেশি ছিল না। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প অধ্যায় শেষ হলে স্বস্তি প্রকাশ করেছিল অনেকেই। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন দায়িত্ব নেন বিদায়ী বছরের শুরুতেই। আর সেই বাইডেনই কিনা বাংলাদেশকে এভাবে উপেক্ষা করলেন! বাইডেনের বহুল আলোচিত গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায়নি বাংলাদেশ। দেশে যে গণতন্ত্রের ঘাটতি আছে, তা এভাবে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা শতমুখে করছেন দেশের মন্ত্রী ও নেতারা।