প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি সেবা প্রাপ্তি অপর্যাপ্ত
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষার মতো সরকারি সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ততা রয়েছে। কোনো এলাকার বিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য পৃথক শৌচাগার নেই। কোথাও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় ওষুধ পাওয়া যায় না। উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির উৎস অপ্রতুল। যেসব উৎস রয়েছে, সেগুলোও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব রয়েছে।
আজ বুধবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় আয়োজিত ‘গণতান্ত্রিক সুশাসন ও উন্নয়ন: জনসম্পৃক্ত তৃণমূল প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ শীর্ষক সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। সম্মেলনের আয়োজন করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও অক্সফাম। দিনব্যাপী সম্মেলনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সরকারসহ বেসরকারি অংশীজনদের অংশগ্রহণ, সক্ষমতা তৈরি, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভূমিকা এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা হয়।
সম্মেলনে জানানো হয়, এসডিজির ১৭টি অভীষ্টের ১২টির বাস্তবায়নে সমন্বিত কমিউনিটি পর্যায়ের কর্মকৌশল প্রয়োজন হবে। এ প্রেক্ষাপটে সিপিডি ও অক্সফাম যৌথ উদ্যোগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় ‘গণতান্ত্রিক সুশাসনে জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি চলবে ২০২১ সাল পর্যন্ত। প্রকল্পের আওতায় সুবিধাবঞ্চিত চর, হাওর ও উপকূলীয় এলাকার ১৩টি জেলার জনগণের মধ্যে এসডিজির আটটি অভীষ্ট বাস্তবায়নে কাজ করা হচ্ছে।
সরকারি সেবার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে প্রকল্পের মাধ্যমে সামাজিক নিরীক্ষা দল গঠন করা হয়। ১৩টি জেলায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপদ পানি, কৃষি ও ভিজিডি—এর ওপর নিরীক্ষা দল তথ্য সংগ্রহ করে। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে ১৩টি সামাজিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রাপ্ত তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এবং দিনব্যাপী আলোচনা শেষে সম্মেলনের অভিপ্রায়পত্র সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এ অভিপ্রায়পত্র সরকারি নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় তুলে ধরা হবে বলে সম্মেলনে জানানো হয়।
শিক্ষাবিষয়ক সামাজিক নিরীক্ষা চালানো হয় কুড়িগ্রামের রৌমারী, জামালপুরের বকশীগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলায়। দেখা যায়, ৪৩ থেকে ৬৮ শতাংশ বিদ্যালয়ে ধারণক্ষমতার বেশি শিক্ষার্থী বসে, ৫২ থেকে ৫৭ শতাংশ বিদ্যালয়ে ছাত্রীদের জন্য আলাদা শৌচাগার নেই। ৩৬ থেকে ৬০ শতাংশ বিদ্যালয়ে বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
স্বাস্থ্যবিষয়ক সামাজিক নিরীক্ষা চালানো হয় চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও বরগুনা সদর উপজেলায়। দেখা যায়, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিকে নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ চাহিদার কারণে পরের চালান আসার আগেই শেষ হয়ে যায়। সামগ্রিকভাবে চাহিদার তুলনায় ওষুধের সরবরাহ অপ্রতুল। যৌন, প্রজনন ও সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে মানসম্মত, দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবলের অভাব রয়েছে।
নিরাপদ পানিবিষয়ক সামাজিক নিরীক্ষা চালানো হয় পিরোজপুর জেলায়। পরিস্থিতি বলছে, পিরোজপুরে পর্যাপ্ত নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নেই। গভীর নলকূপ বসানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় জায়গা নির্ধারণ করা হয়।
কৃষিবিষয়ক সামাজিক নিরীক্ষা চালানো হয় নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের নিকলী এবং সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায়। সেখানে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কৃষকদের সরাসরি যোগাযোগ সীমিত। দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য কৃষিঋণ সহজলভ্য নয়। কৃষকেরা কৃষি অফিস থেকে সরাসরি কোনো প্রশিক্ষণ পান না।
সম্মেলনের সমাপনী পর্বে সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে এসডিজি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। সরকার বলে, এসডিজি বাস্তবায়নে টাকার অভাব আছে। এর মানে কী? সরকারের বাজেট নেই, নাকি সরকার অন্য খাতে বেশি বরাদ্দ দিচ্ছে? বরাদ্দ এলেও তা জনগণের কতটা কাজে লাগছে, তা দেখতে হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘কাউকে পিছিয়ে নয়, সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাব—এসডিজির এই লক্ষ্য অর্জন করা সরকারের পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব ও জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া এটি সম্ভব নয়।’
সমন্বিত উন্নয়ন না হলে তা কোনোভাবেই টেকসই হবে না বলে মনে করেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ আহমদ মজুমদার। তিনি বলেন, এসডিজির শিক্ষাবিষয়ক অভীষ্ট অর্জন করতে পারলে অন্য ৮-১০টি অভীষ্ট অর্জন অনেকটা সহজ হবে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নে প্রয়োজন সদিচ্ছার। সেবাগ্রহীতা ও সেবাপ্রদানকারীদের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে। তৃণমূলের প্রতিষ্ঠানগুলো জনসম্পৃক্ত না হলে এসডিজির অভীষ্ট অর্জন অসম্ভব।
মঙ্গলবার প্রকাশিত বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনের বিষয় উল্লেখ করে ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেন্সজে তেরিংক বলেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক উন্নত দেশের চেয়েও ভালো। এসডিজি বাস্তবায়নে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর একত্রে কাজ করতে হবে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে, ১৫৩টি দেশের নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে ভালো।
সম্মেলনে আরও বক্তৃতা করেন অক্সফামের কান্ট্রি ডিরেক্টর দীপঙ্কর দত্ত, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রমুখ।