বিদ্যুতের প্রি–পেইড মিটার
পৌঁছেছে মাত্র ১০% গ্রাহকের কাছে
মিটার রিডারদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে চলে গেছে দীর্ঘ সময়। এতে কাজে গতি আসেনি।
বিদ্যুৎ খাতে সিস্টেম লস, চুরি, ওভারলোড ও বকেয়া বিল ঠেকাতে প্রি–পেইড মিটার বসানোর উদ্যোগ নিয়েছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক দশকের বেশি সময়ে দেশের প্রায় চার কোটি বিদ্যুৎ গ্রাহকের মধ্যে ১০ শতাংশের কাছে পৌঁছেছে প্রি–পেইড মিটার। দেশের ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এসব তথ্য দিয়েছেন।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, প্রি–পেইড মিটার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০৯-১০ সালে। ২০১৬ সালের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে ১ কোটি ৩২ লাখ মিটার বসানোর কথা। দেশে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৯৬ লাখ। এর মধ্যে প্রি–পেইড মিটারের গ্রাহক দাঁড়িয়েছে ৩৭ লাখ ৬০ হাজার। ২০২৫ সালের মধ্যে শতভাগ প্রি–পেইড মিটার স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা আছে সরকারের।
বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কর্মকর্তাদের ভাষ্য, মিটার রিডারদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে দীর্ঘ সময় চলে যাওয়ায় মিটার স্থাপনের কাজে গতি আসেনি। এরপর একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। মাঝে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনাও হয়েছে। সাধারণ মিটারের পরিবর্তে স্মার্ট মিটার বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০১৯ সালে। এ ছাড়া সব কটি বিতরণ কোম্পানিকে একটি কাঠামোর মধ্যে আনতে সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে।
প্রি–পেইড মিটার স্থাপনে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। শহর এলাকার বাইরে সারা দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে তারা। ৩ কোটি ১১ লাখ গ্রাহকের মধ্যে মাত্র ১১ লাখ ১০ হাজার গ্রাহকের কাছে প্রি–পেইড মিটার পৌঁছাতে পেরেছে আরইবি। আরও পাঁচ লাখ মিটার কেনার দরপত্র চূড়ান্ত হয়েছে। এটির কাজ শুরু হতে আরও ছয় মাস সময় লাগতে পারে। ৩১ লাখ প্রি–পেইড মিটার কেনার একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রক্রিয়াধীন আছে সংস্থাটির। এ ছাড়া চীনের সঙ্গে জিটুজি (সরকারের সঙ্গে সরকার) চুক্তির মাধ্যমে ৫০ লাখ মিটার কিনবে সংস্থাটি।
আরইবির পরিচালক (কারিগরি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থায়ন একটি বড় বিষয়। বিভিন্ন দাতা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চলছে। ২০২৫–এর মধ্যে না হলেও ২০২৬ সালে সবাইকে মিটার নিশ্চিত করা যাবে।’
ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। ডিপিডিসির গ্রাহক আছে ১৪ লাখ ৫৩ হাজার। এর মধ্যে প্রি–পেইড মিটার পেয়েছে ৪ লাখ ৮৫ হাজার। তবে এর চেয়ে এগিয়ে আছে ডেসকো। এ কোম্পানির গ্রাহক ১০ লাখ ৫৪ হাজার। এর মধ্যে প্রি–পেইড মিটার পেয়েছে ৫ লাখ ৩৫ হাজার।
উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগ রাজশাহী ও রংপুরের জেলাগুলোতে শহর এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)। ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে এ কোম্পানি। শুরুতে রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ ও নাটোরে প্রি–পেইড মিটার বসানোর উদ্যোগ নেয় তারা। এর মধ্যে রাজশাহীতে ব্যাপক বাধার মুখে পড়ে তারা। গ্রাহকেরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না মিটার নিতে। এটি এখন সমাধান হয়েছে। ১৬ লাখ ৪৬ হাজার গ্রাহকের এ প্রতিষ্ঠান মিটার দিয়েছে ৬৭ হাজার গ্রাহকের কাছে।
নেসকোর নির্বাহী প্রকৌশলী (কারিগরি ও অপারেশন) আবদুল আজিজ বলেন, ১ লাখ ৪০ হাজার মিটার আনা হয়েছে। ২০২২ সালের
জুনের মধ্যে পাঁচ লাখ মিটার বসানো হবে। ২০২৪ সালের মধ্যেই সব গ্রাহকের কাছে প্রি–পেইড মিটার পৌঁছে যাবে।
সারা দেশে পিডিবির গ্রাহক আছে ৩০ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে প্রি–পেইড মিটার পেয়েছেন ১২ লাখ। ২০১১ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু হলেও গ্রাহক মিটার পেতে শুরু করে ২০১৬ সাল থেকে। শুধু নতুন গ্রাহকদের সাধারণ প্রি–পেইড মিটার দিচ্ছে সংস্থাটি।
পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর শহর এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। প্রায় ২৮ শতাংশ গ্রাহকের কাছে প্রি–পেইড মিটার পৌঁছাতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানটি। ওজোপাডিকোর গ্রাহক আছে ১৩ লাখ ২২ হাজার। আর প্রি–পেইড মিটার পেয়েছেন ৩ লাখ ৬৭ হাজার গ্রাহক।
* আরইবির ৩.৫৭, নেসকোর ৩.৮, ওজোপাডিকোর ২৭.৭৫, ডিপিডিসির ৩৩.৩৯, বিপিডিবির ৪০ ও ডেসকোর ৫০.৭৬% গ্রাহক প্রি–পেইড মিটারের আওতায়। * এই ছয় বিতরণ সংস্থার গ্রাহক ৩ কোটি ৯৬ লাখ। * ২০২৫ সালের মধ্যে শতভাগ প্রি–পেইড মিটার স্থাপনের লক্ষ্য।
প্রি–পেইড মিটার যাঁদের প্রয়োজন
প্রি–পেইড মিটার কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বে আছে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি-গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল। এ সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, লাইফলাইন শ্রেণির গ্রাহক অর্থাৎ যাঁরা ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন, তাঁদের প্রি–পেইড মিটার লাগবে না। এমন গ্রাহক আছে এক কোটি। বাকি তিন কোটি গ্রাহককে প্রি–পেইড মিটারের আওতায় আনা হচ্ছে। নতুন গ্রাহকের জন্য প্রি–পেইড মিটার বাধ্যতামূলক।
প্রি–পেইড মিটার সাধারণত বিতরণ সংস্থার পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হলেও দাম গ্রাহকের কাছ থেকে কিস্তিতে আদায় করা হয়। প্রতি মাসে মিটারের জন্য ৪০ টাকা পরিশোধ করতে হয় গ্রাহককে। এ ছাড়া গ্রাহক চাইলে নিজেও মিটার কিনতে পারেন। বেসরকারি তিনটি কোম্পানিকে খোলাবাজারে মিটার বিক্রির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, প্রি–পেইড মিটার কার্যক্রম পরিচালনায় প্রযুক্তিগত কাঠামো উন্নয়নে সময় লেগেছে। তাই শুরুতে মিটার স্থাপনে গতি কম দেখা গেছে। এখন দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে।
সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বলেছে, দেশের সব গ্রাহককে প্রি–পেইড মিটার সংযোগের আওতায় আনা হলে বিদ্যুতের সিস্টেম লস কমবে এবং গ্রাহকসেবা বাড়বে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুরুর দিকে সময় বেশি লাগাটা যৌক্তিক। কিন্তু গত পাঁচ বছরে অনেক অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল। সবদিক বিবেচনায় এটা সরকারের জন্য ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ।’