শাহনাজ আক্তার পুতুল নামের এক বাইকারের চুরি যাওয়া মোটরবাইক দ্রুততম সময়ে উদ্ধার করে আলোচনায় এসেছে পুলিশ। একদল বলছে, ঢাকা থেকে খোয়া যাওয়া মোটরবাইক ১১–১২ ঘণ্টার মধ্যে নারায়ণগঞ্জের রঘুনাথপুর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ নিজেদের সামর্থ্য আর তৎপরতা দেখিয়েছে। তবে আরেক দল বলছে, এটা পুলিশের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। পুলিশ বাড়তি কিছু করেনি।
বাংলাদেশ পুলিশের সিটিজেন চার্টার বলছে, পুলিশের ‘ভিশন’ হচ্ছে—সব নাগরিককে সেবা প্রদান করা এবং বসবাস ও কর্মোপযোগী নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। আর ‘মিশন’–এর মধ্যে আছে আইনের শাসন সমুন্নত রাখা। সব নাগরিকের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। জনগণের অংশীদারত্বের ভিত্তিতে সামাজিক শান্তি রক্ষা করা। অপরাধ চিহ্নিতকরণ ও প্রতিরোধ। আইন লঙ্ঘনকারীকে বিচারের আওতায় আনা। শান্তি ও জনশৃঙ্খলা রক্ষা। জনগণকে সুরক্ষা, সাহায্য ও সেবা প্রদান এবং আশ্বস্তকরণ। সমব্যথী, বিনম্র ও ধৈর্যশীল হওয়া। অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং উন্নততর কর্মসম্পাদনের পন্থা অন্বেষণ। বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় সাধন।
বাইক চুরি যাওয়ার আগেই শাহনাজ ফেসবুক এবং গণমাধ্যমে আলোচনায় এসেছিলেন। এক মাস ধরে মোবাইল স্মার্টফোনের অ্যাপভিত্তিক ট্যাক্সি-সেবার নেটওয়ার্ক উবারের মাধ্যমে মোটরবাইক চালাচ্ছেন শাহনাজ। ১১ জানুয়ারি অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট রাফিউজ্জামান শাহনাজকে নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘উবারে কল দিলাম। ওপাশে রাইডার ফোন ধরে প্রথমেই বললেন, “ভাইয়া, আমি মহিলা ড্রাইভার, আমার বাইকে চড়তে আপনার আপত্তি নাই তো?” আপত্তি নেই শুনে শাহনাজ বলেন, “আমি আসছি ভাইয়া।”’ তাঁর এই পোস্ট ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে যায় ফেসবুকে।
১৪ জানুয়ারি প্রথম আলো প্রিন্ট এবং অনলাইনে শাহনাজ আক্তারের গল্প ছাপা হয়। অন্যান্য গণমাধ্যমও শাহনাজকে নিয়ে প্রতিবেদন করে। ১৫ জানুয়ারি দুপুরের পর শাহনাজের বাইক জোবাইদুল নামের একজন প্রতারণা করে চুরি করেন। রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা হয়। পুলিশের তেজগাঁও জোনের সদস্যদের তৎপরতায় ১৬ জানুয়ারি দুপুরের মধ্যেই মোটরবাইক উদ্ধারের পর শাহনাজের হাতে তুলে দেওয়া হয়। শুধু তা–ই নয়, শাহনাজের দুই মেয়ের জন্য পুলিশের তেজগাঁও জোনের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকাও তুলে দেওয়া হয়। বাইক উদ্ধারকাজে নেতৃত্ব দেন পুলিশের তেজগাঁও জোনের সহকারী কমিশনার আবু তৈয়ব মো. আরিফ হোসেন। আর আনুষ্ঠানিকভাবে শাহনাজের হাতে বাইকের চাবি তুলে দেন তেজগাঁও বিভাগের পুলিশের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার।
বাইক ফেরত পেয়ে পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন শাহনাজ। তাঁর কাছে এই উদ্ধার অভিযান হিন্দি সিরিয়াল বা সিনেমার গল্পের মতোই মনে হয়েছে। শুধু শাহনাজ নন, বাইক উদ্ধারের পর গণমাধ্যমকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশা–শ্রেণির মানুষ পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। ১৬ জানুয়ারির পর থেকে বিভিন্ন আড্ডায়ও চলে আসছে পুলিশের গল্প। গল্পের মূল বক্তব্য একটাই—পুলিশ চাইলেই পারে।
তবে ঢালাওভাবে সবাই পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়েছে, তা–ও না। ক্ষুব্ধ একটি গোষ্ঠী ফেসবুকসহ বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের ওপর ক্ষোভও ঝেড়েছে। কেননা, তাদের বাইক, মুঠোফোনসহ বিভিন্ন জিনিস চুরি যাওয়ার পর পুলিশের কাছে গেলেও সহায়তা পায়নি। চুরি যাওয়া জিনিসও উদ্ধার হয়নি। শাহনাজের বাইক উদ্ধারে পুলিশকে ধন্যবাদ দেওয়ারও কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না তারা।
প্রথম আলোর ফেসবুক পেজের একজন পাঠক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল নিজামী লিখেছেন, ‘হায়রে, গত বছর যখন আমার বাইক চুরি হয়েছিল, তখন পুলিশ জিডি পর্যন্ত নিতে চায়নি...আসামি খুঁজে না পাওয়ায় মামলা, জিডি কিছুই নেয়নি...।’ এর আগে পুলিশ যাঁদের চুরি যাওয়া জিনিস উদ্ধার করতে পারেনি, তাঁদের অভিমত, শাহনাজের গল্প ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে বলেই পুলিশ সদস্যরা শাহনাজের বাইক উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পুলিশ সদস্যরা জানতেন, শাহনাজের বাইক উদ্ধারের গল্প গণমাধ্যমেও গুরুত্ব পাবে।
প্রথম আলো অনলাইনে কামরুল হাসান নামের একজন পাঠক শাহনাজের বাইক উদ্ধারের ঘটনায় তেজগাঁও বিভাগের পুলিশের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে এ রকম আরও ১০০ বিপ্লব সরকার দরকার। সব সময় পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক খবর পড়তে পড়তে আমরা ক্লান্ত ও আশাহত। একদিন এই দেশে পুলিশ সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক খবর বের হবে না, এই প্রত্যাশায় রইলাম।’ গণমাধ্যমকর্মী, বিশেষ করে অপরাধ বিটে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অনেকেই শাহনাজের বাইক উদ্ধারের পর পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
প্রথম আলোয় শাহনাজ আক্তারকে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপার পরপরই তাঁর বাইক চুরির ঘটনা ঘটে। বাইক চুরির পরপরই তিনি প্রথম আলোতে ফোন করে এ চুরির কথা জানান। বাইক উদ্ধারের পর বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শেখ সাবিহা আলমের ফোনেই তিনি প্রথম জানতে পারেন শাহনাজ নামের একজনের বাইক চুরি হয়েছে। আর এই নারী বাইক চালিয়েই দুই মেয়েসহ পুরো সংসারের হাল ধরেছিলেন। বাইক উদ্ধারের পর শেখ সাবিহা আলম এই পুলিশ কর্মকর্তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘...সবটা শুনে দাদা প্রথম যে শব্দটি উচ্চারণ করলেন, সেটা হলো, হায় হায়। আমি তো এমন পুলিশ চাই, সাধারণ নারীর কষ্ট যাঁকে তাড়িত করে।’
তবে সিটিজেন চার্টারের দায়িত্ব অনুযায়ী পুলিশ যখন সব নাগরিকের বেলায় একইভাবে আচরণ করে না, তখনই সমালোচনার মুখে পড়ে। কেননা ভুক্তভোগী সবারই চাওয়া থাকে, পুলিশ যেন যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে। বিপদে পড়লে তো মানুষ প্রথমে পুলিশের কথাই চিন্তা করে। তবে পুলিশের কাছে গেলে আসলেই সহায়তা পাওয়া যাবে কি না বা গিয়েও সহায়তা না পাওয়ার অভিজ্ঞতার পাল্লা ভারী বলেই মানুষ পুলিশকে ধন্যবাদ দিতে ভুলে যাচ্ছে। শাহনাজ আক্তারের বাইক উদ্ধারে মানুষ আবার পুলিশের প্রশংসা করছে, মানুষের প্রত্যাশাটাও বাড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ। আর পুলিশ যে চাইলেই পারে—এমন মন্তব্য প্রথম আলোর ফেসবুক পেজের আরেক পাঠক সাব্বির হোসেনের। তাঁর ভাষায়, ‘আবারও প্রমাণ হলো পুলিশের সদিচ্ছা ও চেষ্টা থাকলে সব অসম্ভব সম্ভব হয়। আশা করব, সবার বেলায় এ ধরনের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
আরও পড়ুন: