পিতা এবং পুত্র
জন্মের সময় বজলুরের মা তখন কুমিল্লা সরকারি পৌর হাসপাতালের ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি। মরিয়ম বানুর ব্যথা উঠলে তাঁকে অস্ত্রোপচারকক্ষে নেওয়া হলো।
অস্ত্রোপচারের শুরু হতেই মরিয়মের জটিলতা শুরু হলো। বাংলা নাটক সিনেমার মতোই চিকিৎসক অস্ত্রোপচারকক্ষ থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল,
— মা ও পুত্রসন্তান দুজনের অবস্থা সংকটাপন্ন, আমরা যেকোনো একজনকে বাঁচাতে পারব মনে হচ্ছে। বলেন কাকে বাঁচাতে চান আপনি—পুত্রসন্তান, না তার মাকে?
বজলুরের দাদিও উপস্থিত সেখানে। দাদির কাছেই সে শুনেছিল সেদিনের গল্পটা। তার বাবা তখন এক সেকেন্ডও চিন্তা না করে চিকিৎসকের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলেছিলেন,
‘আমার মরিয়মরে বাঁচান। আল্লাহর দোহাই লাগে মরিয়মরে বাঁচায়া রাখেন। হেয় না থাকলে আমি এই দুনিয়ায় বাঁইচা থাকতে পারুম না। যেকোনো মূল্য হ্যারে বাঁচান স্যার...।’
দাদি তখন কিছু একটা বলতে লাগলে কিছু না শুনেই জীবনে প্রথমবার বাবা তার অনেক আদর সম্মান আর যত্নের মাকে ধমক দিয়ে উঠেছিলেন, ‘মা তুমি এইখানে কোনো কথা কওনের চেষ্টা করবা না। পোলা গেলে পোলা পাওন যাইব, মরিয়ম গেলে আমি হেরে আর পামু কই?’
বাবার আশঙ্কাই ঠিক হয়েছিল। সেদিন যে মরিয়মকে হারিয়ে ফেলল আর কখনো পায়নি। আল্লাহর লীলাখেলায় ছেলেটা বেঁচে গেল।
যেদিন থেকে বজলুর বুঝতে শিখেছে, বাবা আসলে তাকে জীবিত চায়নি, সেদিন থেকে মানুষটার জন্য একটা অদ্ভুত রকমের মিশ্র অনুভূতি কাজ করে তার মধ্যে। তীব্র অভিমান হয়, রাগ হয়। বাড়ির পেছনে বাবা যখন মায়ের কবরটার কাছে লুকিয়ে কাঁদে, তখন তার জন্য মায়া হয়। আবার কান্নার সময়ে বজলুর যদি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়, তখন বাবার চোখমুখ মুছে এমন ভান ধরে, যেন গুনগুনিয়ে গান করছে। ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, যেন খোলামেলা শীতল বাতাসে বসে চরম শান্তি পাচ্ছে, তার শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে।
বজলুরের তখন ভীষণ ইচ্ছে করে বাপটার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, শক্ত করে চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে। কিন্তু বজলুর কোনোভাবেই বাপকে বুঝতে দিতে রাজি নয়, বাপের কষ্টটা সে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করতে পারে।
বজলুর টের পায় সে কি সাংঘাতিক রকমের কষ্ট।
* মেহেদী হাসান তামিম