সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি যখন সরকারি প্রকল্পের সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করার নজির গড়েছে পটুয়াখালীর পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয়ও প্রাক্কলিত পরিমাণের চেয়ে কম হয়েছে। অবশ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সরকারের ১০ অগ্রাধিকার প্রকল্পের তালিকায় ছিল না। ওই তালিকায় থাকা দুই বিদ্যুৎকেন্দ্র রামপাল ও মাতারবাড়ী এখন পর্যন্ত উৎপাদনে আসেনি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে উৎপাদনে আসা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি সবচেয়ে বড়। এটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৪৭ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছে ২৩০ কোটি ডলার (প্রায় ১৯ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা)।
দেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে কম সময়ে এমন বড় অবকাঠামো নির্মাণ করার ঘটনা নেই। বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য এটি বড় সাফল্য। প্রকল্পের ব্যয় বা মেয়াদ বাড়েনি, বরং সাশ্রয় হয়েছে
পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের একটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সাধারণত ছয় বছর সময় লাগে। তাদের সময় দেওয়া হয়েছিল ৪৮ মাস (চার বছর)। নির্মাণ শেষ হয়েছে এক মাস আগেই।
পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি। আর দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদন শুরু করে একই বছরের ২৬ আগস্ট। তবে করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময় পাওয়ার অপেক্ষায় এত দিন কেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল সোমবার এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন বলে কথা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক–ই–ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় সাজসজ্জা করা হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে কম সময়ে এমন বড় অবকাঠামো নির্মাণ করার ঘটনা নেই। বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য এটি বড় সাফল্য। প্রকল্পের ব্যয় বা মেয়াদ বাড়েনি, বরং সাশ্রয় হয়েছে।
বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে অর্থের জোগান করতে দেড় থেকে দুই বছর লেগে যায়। এখানে তা হয়েছে এক মাসের মধ্যে। এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ হয়েছে মাত্র আট মাসে। প্রকল্পের অনেক কাজ একই সঙ্গে চলেছে। সব মিলে কম সময়ের মধ্যে এটি করা সম্ভব হয়েছে।
দুই দেশের মালিকানা
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় কয়লাভিত্তিক পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ ও চীনের দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির সমান অংশীদারত্বে গঠিত বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। এই কোম্পানির ৫০ শতাংশ করে মালিকানায় আছে দেশের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড ও চীনের চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)।
পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে চুক্তি করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। চুক্তির এক মাসের মাথায় অর্থায়নের চুক্তি করে বিসিপিসিএল। প্রকল্পের ৮০ শতাংশ অর্থ এসেছে চীনের এক্সিম ব্যাংকের ঋণসহায়তা থেকে।
বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে অর্থের জোগান করতে দেড় থেকে দুই বছর লেগে যায়। এখানে তা হয়েছে এক মাসের মধ্যে। এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ হয়েছে মাত্র আট মাসে। প্রকল্পের অনেক কাজ একই সঙ্গে চলেছে। সব মিলে কম সময়ের মধ্যে এটি করা সম্ভব হয়েছে।
অবশ্য পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে পরিবেশবাদীদের অভিযোগ রয়েছে যে কয়লার ব্যবহারের কারণে এটি পরিবেশের ক্ষতি করবে। বছরে ৪০ লাখ টন কয়লা ব্যবহার করা হবে এ কেন্দ্রে। অবশ্য প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, এই কেন্দ্রে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে, যা পরিবেশবান্ধব সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। কার্বন নিঃসরণের হার পরিমাপ করে এখানে নিয়মিত পরিবেশদূষণ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তেমন ক্ষতিকর কিছু ঘটেনি।
পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৩তম দেশ হিসেবে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বলে জানিয়েছে বিসিপিসিএল।
পিডিবি সূত্র বলছে, এখন ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি ব্যয় প্রায় ৩০ টাকা, ফার্নেস তেলে ১৪ টাকা ও কয়লায় ৭–৮ টাকা। সবচেয়ে কম ব্যয় গ্যাসে, ইউনিটপ্রতি ৪ টাকার মতো। সার্বিকভাবে দেশে এখন গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ইউনিটপ্রতি সাড়ে ৮ টাকার মতো।
সঞ্চালনে বিকল্প ব্যবস্থা
পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সময়মতো উৎপাদনে এলেও সঞ্চালন লাইনের কারণে কেন্দ্রটি থেকে ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ করতে পারেনি পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। এ কারণে চুক্তি অনুযায়ী পায়রা থেকে বিদ্যুৎ কিনতে না পারার দায়ে পিডিবিকে প্রতিদিন বড় অঙ্কের জরিমানা গুনতে হচ্ছিল।
অবশ্য এখন একটি বিকল্প উপায় বের করেছে বিসিপিসিএল। কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থায়নে একটি উপকেন্দ্র বসিয়ে পটুয়াখালী জেলাতেই ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া বিকল্প সঞ্চালন লাইন ব্যবহার করে খুলনা-যশোর এলাকায় এই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে এখন সক্ষমতার ৮৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে। এদিকে পিজিসিবি যে সঞ্চালন লাইন তৈরি করছে, তার কাজ শেষ হতে পারে আগামী ডিসেম্বরে।
সময়, অর্থ ও প্রযুক্তি বিবেচনায় পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের অন্যতম সেরা একটি প্রকল্প। বিদ্যুৎ খাতের জন্য এটি মাইলফলক, অন্য প্রকল্পের জন্য নজির। তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় এই কেন্দ্র থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। সঞ্চালন লাইন তৈরি ও কয়লার সরবরাহ ঠিক রেখে কেন্দ্রটির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে
উৎপাদন ব্যয় কত
পিডিবি সূত্রে জানা যায়, পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের আগে দেশে সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা ছিল ৪৫০ মেগাওয়াট। এই ক্ষমতার তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। অবশ্য বড় আরও তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আগামী কয়েক বছরে উৎপাদনে যাবে বলে আশা রয়েছে। সেগুলো হলো ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ও কক্সবাজারের মাতারবাড়ীর ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমে। কারণ, তখন ডিজেল ও ফার্নেস তেলভিত্তিক ছোট কেন্দ্রের ওপর নির্ভরতা কমে যায়।
পিডিবি সূত্র বলছে, এখন ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি ব্যয় প্রায় ৩০ টাকা, ফার্নেস তেলে ১৪ টাকা ও কয়লায় ৭–৮ টাকা। সবচেয়ে কম ব্যয় গ্যাসে, ইউনিটপ্রতি ৪ টাকার মতো। সার্বিকভাবে দেশে এখন গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ইউনিটপ্রতি সাড়ে ৮ টাকার মতো।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, সময়, অর্থ ও প্রযুক্তি বিবেচনায় পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের অন্যতম সেরা একটি প্রকল্প। বিদ্যুৎ খাতের জন্য এটি মাইলফলক, অন্য প্রকল্পের জন্য নজির। তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় এই কেন্দ্র থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। সঞ্চালন লাইন তৈরি ও কয়লার সরবরাহ ঠিক রেখে কেন্দ্রটির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।