পাহাড়ে পথ হারিয়ে ৯৯৯–এ ফোন, গেল হেলিকপ্টার
কক্সবাজারের ছেলে অভীক পাল ও তাঁর তিন বন্ধু যখন হিমছড়ির দিকে যাত্রা শুরু করেন, ঘড়িতে তখন সকাল সাতটা। সোজা পথে না গিয়ে পাহাড়ি পথ ধরে যাবেন এমনটাই ইচ্ছা। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের শেষটা যে এমন হবে কে জানত?
শেষ পর্যন্ত অভীক ও তাঁর তিন বন্ধু সাইমুম আলম রাফসান, মিজবাহ ও আবির শাহ বাড়ি ফিরতে পেরেছেন। তবে সে জন্য তাঁদের জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এর সাহায্য নিতে হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল থেকে তাঁদের উদ্ধারে উড়ে যায় বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারও। তা–ও শেষ রক্ষা হয়নি। তাঁদের উদ্ধারে এগিয়ে আসা এক তরুণ গুরুতর আহত অবস্থায় এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
গত শনিবার দিনভর কক্সবাজারের রামুর দরিয়ানগরে ঘটে গেল এত সব ঘটনা। গত রোববার রাতে অভীক তাঁদের সেই অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শোনালেন প্রথম আলোকে।
অভীকদের কক্সবাজার থেকে পাহাড় ডিঙিয়ে হিমছড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা বেশ পুরোনো। ব্যাটে-বলে হয়ে উঠছিল না। চার বন্ধুর মধ্যে অভীকই এখন পড়ালেখায় আছেন। কক্সবাজার কলেজে স্নাতক শ্রেণির ছাত্র। সাইমুম ও আবির বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। মিজবাহর লেখাপড়া সম্প্রতি শেষ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত শনিবারকেই বেছে নেন তাঁরা।
শুকনা খাবার, কিছু ফলমূল, কয়েক বোতল পানি আর গুগল ম্যাপ সঙ্গে করে কক্সবাজার থেকে রওনা দেন চার বন্ধু। কক্সবাজারের ছেলে সবাই। ভোরের আলোয় পাহাড়ি পথ বেয়ে এগোন চার বন্ধু। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট ঘর। ঘরের কাছেই খেতখামার করেছেন পাহাড়ের বাসিন্দারা। বেশ অনেকটা দূর পর্যন্ত পায়ে চলাপথ পান তাঁরা। শীতের সকাল। গাছের পাতা ভেদ করে গায়ে পড়ে নরম আলো।
দুটি পাহাড় পার হওয়ার পর আর লোকালয় খুঁজে পাননি অভীকেরা। নেই পায়ে চলা পথও। হাতির মল এখানে–সেখানে। তখন সকাল সাড়ে ১০টা কি ১১টা। এর মধ্যেই দু-একজন ফেরার কথা বলতে শুরু করেছেন। এ নিয়ে ছোটখাটো একটা বৈঠকও হয়ে যায় তাঁদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত তাঁরা এগোবেন বলেই ঠিক হলো। এবারের পথটা ঝিরিপথ।
ঝিরি কী—এমন প্রশ্নের জবাবে অভীক বললেন, ছোট ঝরনাকে তাঁদের এলাকায় ঝিরিপথ বলে। কয়েকটি পাহাড় ও ঝিরিপথ পেরিয়ে তাঁরা নতুন একটি পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছালেন। এবারকার পাহাড়টা একটু কেমন যেন। অনেক বেশি খাদ মনে হচ্ছিল। তারপরও ওপরের দিকে উঠতে থাকেন তাঁরা। ঘড়িতে সময় তখন সাড়ে ১২ কি ১টার মতো হবে। এই পাহাড়ের সব জায়গায় নেটওয়ার্ক নেই। গুগল ম্যাপ তাই কাজ করছে না। তাঁরা পরের পাহাড়ে ওঠার জন্য এই পাহাড় থেকে নামার চেষ্টা করতে থাকেন। ঘণ্টা দুয়েক ধরে চেষ্টার পর বুঝতে পারেন, তাঁরা আসলে ঘুরেফিরে একই জায়গায় আছেন। পাহাড় থেকে নামতে পারেননি।
অনেক চেষ্টার পর অভীকেরা একটা জায়গায় ফোনের নেটওয়ার্ক পান। বন্ধুবান্ধবকে জানান, তাঁরা পাহাড়ে আটকা পড়েছেন।
অভীক বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ৯৯৯–এ ফোন করেন। এরপর থেকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল পুলিশের সঙ্গে। ঠিক যে জায়গাটায় আছেন সেখানকার ছবিও তুলে পাঠান। এই করে কেটে যায় দুই ঘণ্টা। পরে চট্টগ্রাম থেকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার এসে পৌঁছায়। এই সময়ে এসে পৌঁছায় বন্ধু পারভেজের ছোট ভাই ইব্রাহীমও।
হেলিকপ্টারকে নিজেদের অবস্থান বোঝাতে তাঁরা খড়কুটোয় আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া তৈরি করেছিলেন। লাল টি–শার্ট উড়িয়ে তাঁদের উপস্থিতির জানান দিয়েছিলেন। হেলিকপ্টার এসে একে একে তাঁদের চারজনকে তুলে নেয়। ইব্রাহীমকেও সঙ্গে যাওয়ার অনুরোধ করেন অভীক ও তাঁর বন্ধুরা। কিন্তু তিনি রাজি হননি। বলেছিলেন, সাবধানে নিজের মতো করে পৌঁছে যাবেন। তা আর হয়নি।
অভীক জানান, ফেরার পথে ছেলেটি খাদে পড়ে যায়। মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেছে তাঁর। এখন কক্সবাজারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানা রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, তরুণেরা যে জায়গাটায় আটকা পড়েছিলেন, সেটা রামু থানা এলাকার দরিয়ানগর পাহাড়। তাঁরা সেখান থেকে সাগরে বিমানবাহিনীর মহড়াও দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁরা ৯৯৯–এর সাহায্য চাওয়ার পর ৯৯৯ থেকে বিমানবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ফোন করে বিষয়টি জানানো হয়।
পরে বিমানবাহিনীর ‘In Aid to Civil Power’–এর আওতায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হক, চট্টগ্রাম সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ টিম গঠন করে।
মো. সোহেল রানা আরও জানান, বিকেল সাড়ে চারটায় বিমানবাহিনীর একটি এডব্লিউ-১৩৯ সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ হেলিকপ্টার দ্রুত ঘটনাস্থলে পাঠায়। সাড়ে পাঁচটায় বিমানবাহিনী চার তরুণকে উদ্ধার করে কক্সবাজার বিমানবন্দরে নিয়ে আসে। পাহাড়ে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করার মতো উপযুক্ত স্থান ছিল না। তাই তরুণদের বিশেষ রেস্কিউ রোপের সাহায্যে হেলিকপ্টারে ওঠানো হয়।
অভীক পাল ও তাঁর বন্ধুরা পুলিশ ও বিমানবাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু ইব্রাহীমের কষ্টটা তাঁদের পীড়িত করছে। রোববার অনেকটা সময় ইব্রাহীমের পাশে ছিলেন তাঁরা। ওঁদের উদ্ধারে এসে আহত ইব্রাহীম দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক এই তাঁদের একমাত্র চাওয়া।