মিশনে আবেদন
পাসপোর্টে তথ্য বদলাতে চান ১৫ হাজার প্রবাসী
অনেকেই তথ্য আমূল বদলাতে চান। এ সুযোগ দেওয়া হলে নানা সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশি পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
মানব পাচার উৎসাহিত হওয়ার আশঙ্কা। রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট পেয়ে যেতে পারে।
সুরাহার পথ খুঁজতে কমিটি গঠন।
পাসপোর্টে নিজের নাম, পিতা–মাতার নাম, বয়স, ঠিকানাসহ বিভিন্ন তথ্য সংশোধন ও পরিবর্তন চেয়ে বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতে ১৫ হাজার ১০১ জন প্রবাসী আবেদন করেছেন। কেউ কেউ চান আংশিক পরিবর্তন। তবে অনেকেই তথ্যাদি আমূল বদলে ফেলতে চান। যেমন ১ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত বয়স পরিবর্তনের আবেদনও রয়েছে।
মালয়েশিয়া, ইতালি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিরা সাম্প্রতিককালে এসব এসব আবেদন করেন। আবেদনগুলো নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নীতিগতভাবে প্রবাসীদের জন্য এসব পাসপোর্টের তথ্য সংশোধন করে দেওয়ার পক্ষে। তবে তথ্যের আমূল পরিবর্তনের বিষয়টিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলেও মনে করছেন তাঁরা।
কী কী সমস্যা তৈরি হতে পারে, তা উঠে আসে গত মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভায়। তথ্য সংশোধন করে প্রবাসীদের পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন নিষ্পত্তি নিয়ে এ সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পক্ষ থেকে অন্তত পাঁচটি সমস্যা তুলে ধরা হয়, তা হলো—মানব পাচার উৎসাহিত হতে পারে; আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশি পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা ও মান প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে; রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেয়ে যেতে পারে; বিদেশি নাগরিকেরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিতে পারেন, যাঁর পাসপোর্টের তথ্য অনেকটা বদলে ফেলা হবে; তাঁর সম্পদের উত্তরাধিকারী নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, পাসপোর্টে সাধারণ কিছু তথ্য পরিবর্তন ও ত্রুটি সংশোধন একটি নিয়মিত কার্যক্রম। তবে এবার যেহেতু অনেকেই তথ্যে ব্যাপক পরিবর্তনের আবেদন করেছেন, তাই সমস্যাটি সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, দেশে আবেদন করে পাসপোর্টে তথ্য পরিবর্তন করতে, বিশেষ করে পিতা-মাতার নাম, বয়স প্রভৃতি বদলাতে জাতীয় পরিচয়পত্র, অ্যাফিডেভিট এবং পুলিশের বিশেষ শাখা বা পুলিশের সন্তোষজনক প্রতিবেদন প্রয়োজন হয়। বিদেশে আবেদনের ক্ষেত্রে ডেপুটি হাইকমিশনার বা ডেপুটি চিফ অব মিশন পর্যায়ে কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত প্রতিবেদন পাওয়ার পর তথ্য পরিবর্তনের আবেদন বিবেচনা করা হয়।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে এসব তথ্য বদলানোর ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যার কথা জানান। সেটি হলো, বিভিন্ন পথে অবৈধভাবে ইউরোপে ঢোকার পর অনেকে তাঁদের পাসপোর্ট নষ্ট করে ফেলেন। কারণ, পাসপোর্টের আনুষ্ঠানিক তথ্য অভিবাসন কর্তৃপক্ষের হাতে গেলে তাঁরা অবৈধ অভিবাসীর পরিচয় নিশ্চিত হতে পারে এবং তাঁকে ফেরত পাঠানোর সুযোগ পায়। ইউরোপে অবৈধ অভিবাসী বাংলাদেশিরা সাময়িক বসবাসের অনুমতি ও কাজের সুযোগ পাওয়ার পর স্থায়ী বসবাসের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। ওই আবেদন ও অন্য নথিপত্রের সঙ্গে মিল রেখে আগের তথ্য পরিবর্তন করে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভায় উপস্থিত পুলিশের প্রতিনিধি বলেন, সাম্প্রতিককালে শিক্ষার্থী ও ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশিরা তুরস্ক, গ্রিস ও ইউরোপে যাচ্ছেন। পরে তাঁরা ওই সব দেশে অবৈধভাবে অবস্থান করে নানা সমস্যা তৈরি করেন। ফলে বৈধ অভিবাসীরা হয়রানির শিকার হন।
সভায় নীতিমালার বাইরে গিয়ে পাসপোর্টের তথ্য আমূল বদলানোর পরিবর্তনের সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে অবশ্যই মানদণ্ড ঠিক রাখতে হবে। কারণ এর সঙ্গে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি জড়িত।
অন্যদিকে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশে মিশনগুলো সব সময় প্রবাসী বাংলাদেশিদের সহায়তা দিতে প্রস্তুত জানিয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সভায় বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো ম্যাজিক সলিউশন (জাদুকরি সমাধান) নেই।’
পাসপোর্টের তথ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদের মতো বিষয় নিয়েও ভাবতে হচ্ছে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এমনও হতে পারে কোনো জঙ্গি নাম বা তথ্য পরিবর্তন করে প্রবাস থেকে দেশে ঢুকে যেতে পারে। আবার মৃত ব্যক্তির নামে পাসপোর্ট ইস্যু হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এ ছাড়া জন্মতারিখ ও পিতা-মাতার নাম বদলে নানা ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ড করা সম্ভব।
সার্বিক বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা ও মান যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, তা বিবেচনায় নিয়েই এসব তথ্য পরিবর্তনের আবেদন নিষ্পত্তি করতে হবে।