পানিতে ভূগর্ভস্থ উৎসেই চাপ বাড়ছে
পানির জন্য পর্যায়ক্রমে ভূগর্ভস্থ উৎসের ওপর চাপ কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ উৎসে জোর দেওয়ার কথা বলছে ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু বাস্তবে ভূগর্ভস্থ উৎসে আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে সংস্থাটি। ক্রমেই বাড়ছে গভীর নলকূপের সংখ্যা। ফলে পানির স্তর আরও নেমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ওয়াসার তথ্যমতে, গত বছরের জুনে ওয়াসার গভীর নলকূপের পাম্পের সংখ্যা ছিল ৮৫৫টি। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী ওয়াসার পাম্পের সংখ্যা ৯২৮। এক বছরে পাম্প বেড়েছে ৭৩টি।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে ওয়াসার মোট উৎপাদিত পানির ২২ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাকি ৭৮ শতাংশ পানি ভূগর্ভস্থ উৎস তথা গভীর নলকূপের মাধ্যমে আসে। কর্তৃপক্ষ ২০২১ সাল নাগাদ ঢাকা শহরে সরবরাহকৃত পানির ৭০ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস থেকে সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে। কিন্তু পরিকল্পনামাফিক অগ্রগতি হচ্ছে সামান্যই।
গত ২৮ মার্চ ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান ওয়াসা ভবনে শুকনা মৌসুমে পানির সরবরাহ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘বর্তমানে ঢাকা ওয়াসা মোট পাঁচটি পানি শোধনাগারের মাধ্যমে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে শোধনের পর রাজধানীতে দৈনিক ৪৯ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করছে। অবশিষ্ট ২০৬ কোটি লিটার পানি ৮৬৫টি গভীর নলকূপ হতে উত্তোলন করা হচ্ছে।’ তিনি ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ, মূলত নদীর পানির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর তাগিদ দিয়েছেন।
ওয়াসার দায়িত্বশীল সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে একটি গভীর নলকূপের পাম্প স্থাপনে খরচ হয় গড়ে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা। প্রায় এক বছরে ৭৩টি পাম্প বেড়েছে, সেগুলোর জন্য খরচ হয়েছে ৮০ কোটি টাকার বেশি। হালনাগাদ হিসাবে, ৯২৮টি গভীর নলকূপের পাম্পের মধ্যে ওয়াসার যাত্রাবাড়ীসহ ১ নম্বর অঞ্চলে ৮১টি, পুরান ঢাকা নিয়ে গঠিত ২ নম্বর অঞ্চলে ৬৫টি, ধানমন্ডি এলাকায় অঞ্চল ৩–এ ১৩৭টি, মিরপুর ১ নিয়ে গঠিত ৪ নম্বর অঞ্চলে ১১৫টি, গুলশান–মহাখালীসহ নিয়ে গঠিত ৫ নম্বর অঞ্চলে ৭৭টি, ফকিরাপুলে ৬ নম্বর অঞ্চলে ১১৮টি, শনির আখড়া, মাতুয়াইলসহ ৭ নম্বর অঞ্চলে ৫২টি, বাড্ডায় ৮ নম্বর অঞ্চলে ৭৩টি, উত্তরা নিয়ে গঠিত ৯ নম্বর অঞ্চলে ৭৫টি, মিরপুর ১০ নিয়ে ১০ নম্বর অঞ্চলে ১০৪টি এবং নারায়ণগঞ্জে ৩১টি পাম্প রয়েছে।
>ভূ–উপরিস্থ পানির ব্যবহারের কথা বলা হলেও গভীর নলকূপের সংখ্যা বাড়ছে
গেল এক বছরে ৭৩টি পাম্প বসাতে খরচ হয়েছে ৮০ কোটি টাকার বেশি
ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানোর কথা বলা হলেও ২০১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পের অংশ হিসেবে সাভারের ভাকুর্তায় ৫৭২ কোটি টাকা খরচ করে একসঙ্গে ৪৬টি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। ১৫ কোটি লিটার পানি উত্তোলনে সক্ষম এই প্রকল্পের পানি গত এপ্রিল থেকে ঢাকার মিরপুরে সরবরাহ করা হচ্ছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। প্রতিদিন ১৫ কোটি লিটার সরবরাহের কথা বলা হলেও বাস্তবে সরবরাহ হচ্ছে সাড়ে সাত কোটি লিটার।
ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, ভূ-উপরিস্থ উৎসের দিকে ক্রমেই অগ্রসর হলেও রাজধানীবাসীর ক্রমবধর্মান চাহিদা পূরণে নগরীর বিভিন্ন স্থানে গভীর নলকূপ স্থাপন করতে হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক বছরে যদি পাম্পের সংখ্যা ৭৩টি বাড়ে, তাহলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর উদ্যোগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তা ছাড়া ২০২১ সালের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানি যদি মোট চাহিদার ৩০ শতাংশ নেওয়া হয়, তাহলে এ পাম্পগুলোকে অকেজো অবস্থায় বসিয়ে রাখতে হবে। শত শত কোটি টাকা নষ্ট হয়ে যাবে।
এ ছাড়া নগরীর বেশির ভাগ স্থানে পানি সরবরাহের নতুন পাইপলাইন এখন পর্যন্ত বসানো যায়নি। পুরান ঢাকাসহ নগরীর বেশির ভাগ এলাকায় বহু বছরের পুরোনো পাইপে ফুটো হয়ে গেছে। পুরোনো হওয়ার কারণ ছাড়াও অবৈধ সংযোগ নেওয়ার ফলেও এসব ফুটোর সৃষ্টি হয়েছে। এই ফুটো পথে ময়লা, এমনকি পয়োনালার পানিও পাইপলাইনে ঢুকে পড়ে। পাম্পের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি ওঠানোর পর এসব পাইপলাইনে গিয়ে পানি দূষিত হয়ে পড়ে। সেই পানি সরবরাহ হয় গ্রাহকদের বাসাবাড়িতে।
পানির পাম্পের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ানোর বিষয়ে জানতে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মুঠোফোনে যোগাযোগ চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। ওয়াসার অপর একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিভিন্ন এলাকার পাম্প নষ্ট বা পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে নতুন পাম্প বসাতে হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ওয়াসার পানির পাম্পের সংখ্যা অনেক হলেও সব কটি হয়তো চালায় না। কোনো কোনোটা বিকল বা সংরক্ষণেও থাকে। তবে ভূ–উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য নির্মাণাধীন শোধনাগার ও সঞ্চালন লাইন বসানোর কাজ দ্রুত শেষ করে দ্রুত পানি সরবরাহ করা উচিত।