‘পানি, শীতো আর মোর কষ্ট হইবে না’

জয় বাংলা আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৬টি পাকা ঘরে আগামীকাল রোববার ঠাঁই হবে রংপুরের তারাগঞ্জের কুর্শা ইউনিয়নের ১৬টি পরিবারের
ছবি: প্রথম আলো

কাজলী বেগমের দুই সন্তান। স্বামী পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। ভিক্ষা করে তাঁর সংসার চলে। জয় বাংলা বাজারের পাশের রাস্তার ধারে পলিথিনের ছাউনি দিয়ে থাকতেন। সামান্য বৃষ্টি হলে বেড়া ফাঁক দিয়ে ঘরে পানি ঢুকত। গত চার বছরে তাঁদের দুবার থাকার জায়গা বদলাতে হয়েছে। নিজেদের বসতভিটা না থাকায় তাঁদের এমন দুঃখ আর দুর্ভোগ।

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের জয় বাংলা গ্রামের স্বামীহারা এই নারীর দুঃখ এবার ঘুচেছে। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে সে সরকারের দেওয়া জমিসহ পাকা ঘর পাচ্ছেন। ইতিমধ্যে ওই নারীর নামে দুই শতাংশ খাসজমি দলিল করে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। রোববার জয় বাংলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘর দেওয়া হবে।
কাজলী বলেন, ‘মোর খুব কষ্ট। থাকপার ঘর আছলো না। হাসিনা বেটি মোক জমি দিছে, পাকা ঘর দেবে। পানি, শীতো আর মোর কষ্ট হইবে না। ছাওয়া দুইট নিয়া পাকা ঘরো আরামে থাকিম।’

ওই ইউনিয়নের খিয়ারপাড়া গ্রামের মানু রায়ের গল্পটা একটু ভিন্ন। তিনি ভূমিহীন ছিলেন না। বাবার দেড় একর জমিতে চাষাবাদ করে ভালোই চলত সংসার। ২০১১ সালে যমুনেশ্বরী নদীর গর্ভে তাঁর আবাদি জমি বিলীন হয়ে যায়। এরপর থেকে খিয়ারপাড়া হরিমন্দিরের সামনে খড়ের ছোট একটি ঘর তুলে থাকতেন। তাঁর নামেও দুই শতক জমি লিখে দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল তাঁর হাতেও জয় বাংলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে নতুন ঘরের চাবি তুলে দেওয়া হবে।

মানু রায় বলেন, ‘মুই তো গরিব আছনু না। নদী মোক ফকির বানাইছে। কিন্তুক ইউএনও স্যার মোর কষ্টের কথা শুনি বাড়ি থাকি তুলি আনি দুই শতক জমি লেখি দিছে। রোববার মোক পাকা ঘরের চাবি দিবে। মুই কোনো দিন ভাবো নাই পাকা ঘর পাইম।’

কাজলী ও মানু রায়ের মতো ভূমিহীন দরিদ্র ১৬টি পরিবারের ঠাঁই হবে কুর্শা ইউনিয়নের জয় বাংলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে। এ ছাড়া কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১৬টি, সয়ার ইউনিয়নের ফরিদাবাদ আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৪০টি, আলমপুর ইউনিয়নের দর্জিপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২৮টি ভূমিহীন অসহায় পরিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় জমিসহ ঘরের মালিক হচ্ছেন।

আজ শনিবার ফরিদাবাদ আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায় সারি করে সাজানো চকচকে রঙিন টিনের ঘর। প্রতিটি ঘরের পেছনে নির্মাণ করা হয়েছে শৌচাগার। দেখে মনে হয় পরিপূর্ণ সাজানো ছবির মতো একটি গ্রাম। এই প্রতিবেদককে দেখে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ছুটে আসেন বুড়িরহাট গ্রামের ছলিমা বেগম (৪০)। আশ্রয়ণ প্রকল্পের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর স্বামী নয়ন মিয়া পাঁচ বছর আগে তাঁকে ছেড়ে চলে যান। দুই সন্তানকে নিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে অতিকষ্টে চলত তাঁর জীবন। কোনো জমি নেই। থাকতেন বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের পেছনে খুপরি তুলে। কথা বলার একপর্যায়ে ছলিমার চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি বললেন, ‘মাইনসের বাড়ির কাম করি খাও। ঘর বানার টাকা কোনটে পাইম। আল্লাহ মোর পেকে তাকাইছে। সরকার মোক জমিসহ ঘর দেওছে। মুই খুব খুশি। পাকা ঘরোত বাকি জীবন শান্তিতে কাটাইম।’

আলমপুর ইউনিয়নের দর্জিপাড়া গ্রামের জোবাদ্দি হোসেন-হাসিনা বেগম দম্পতির চোখেমুখে হাসির ঝিলিক। জোবাদ্দি হোসেনের বয়স ৬৫ পেরিয়েছে। চোখে ঝাপসা দেখেন, চলেন লাঠিতে ভর দিয়ে। নেই কোনো সহায়–সম্বল। স্ত্রী ভিক্ষা পেলে খাবার জোটে, না পেলে অনাহারে দিন কাটে। দর্জিপাড়া গ্রামের চিকলী নদীর ধারে পলিথিন দিয়ে খুপরি করে কষ্টে জীবন যাপন করতেন। তাঁদেরও দর্জিপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে জমিসহ ঘর দেওয়া হবে।

জোবাদ্দি হোসেন বলেন, ‘এদ্দিন তো মোর থাকার খুব কষ্ট আছলো। ইউএনও স্যার মোর নামে জমি দিছে। পাকা ঘরও দেবে। ওই ঘরোত মুই শান্তিতে ঘুমাইম।’
জানতে চাইলে ইউএনও আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘চারটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১০০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ঘর নির্মাণের জন্য ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই কাজ করতে জেলা প্রশাসক স্যার সাহস জুগিয়েছেন। স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতা পেয়েছি।’

তারাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান বলেন, আশ্রয়ণ চারটি প্রকল্পে আশ্রয় পাওয়া সবাই ভূমিহীন, দিনমজুর, ভিক্ষক। তাঁদের পাকা ঘর করার সামর্থ্য ছিল না। জমিসহ তাঁদের জন্য ঘর নির্মাণ করায় তাঁরা খুব খুশি।