নিরাপদ খাদ্য দিবস আজ
পাউরুটিতে ক্ষতিকর উপাদান
গবেষণার তথ্য বলছে, ৬৭ শতাংশ পাউরুটিতে ক্ষতিকর পটাশিয়াম ব্রোমেটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
করোনাকালে দেশে যে কয়েকটি পণ্যের বিক্রি বেড়েছে, সেগুলোর মধ্যে পাউরুটি অন্যতম। ছয় বছর ধরে পাউরুটির বাজার ১২ শতাংশ হারে বাড়ছিল। বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব বলছে, গত বছর করোনাকালে এর বিক্রি বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।
কিন্তু যে হারে এর বিক্রি বাড়ছে, সে অনুযায়ী মান নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না বলে নানা গবেষণায় উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন এমন কথা। দীর্ঘদিন ধরে দেশের অনেক পাউরুটি ও বেকারি পণ্যে কাঁচামাল হিসেবে আটার সঙ্গে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান ট্রান্সফ্যাট, কৃত্রিম রং ও মিষ্টিজাতীয় রাসায়নিক দ্রব্য সোডিয়াম সাইক্লোমেট ব্যবহৃত হচ্ছে। গত মাসে একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়কীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হওয়া পাউরুটির বড় অংশে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর আরেক উপাদান পটাশিয়াম ব্রোমেট ব্যবহৃত হচ্ছে।
পাউরুটিতে এ ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা গুরুতর অপরাধ। বিএসটিআইয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও বেকারির মালিকদের অতি লোভের জন্য এসব হচ্ছে। সরকারের উচিত এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ কঠোর হওয়া
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষকের উদ্যোগে করা ওই গবেষণায় রাজধানীসহ দেশের চারটি জেলা থেকে ২১টি পাউরুটির নমুনা পরীক্ষা করা হয়। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এক কেজি পাউরুটিতে ৫ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম ব্রোমেট ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু ৬৭ শতাংশ পাউরুটির নমুনায় ওই মানমাত্রার চেয়ে বেশি পটাশিয়াম ব্রোমেট পাওয়া গেছে। পাউরুটি ফোলাতে ও বিভিন্ন আকৃতি দিতে এই রাসায়নিক উপাদানটি ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বের বেশির ভাগ উন্নত দেশে খাবারে এই উপাদানটির ব্যবহার নিষিদ্ধ।
বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স শাখার পরিচালক মো. সাজ্জাদুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাউরুটি তৈরিতে পটাশিয়াম ব্রোমেট ব্যবহার যদি মানমাত্রার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আমরা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল ও এক লাখ টাকা জরিমানা করে থাকি। তবে মূলত লাইসেন্স নবায়নের সময় আমরা তাদের পাউরুটিগুলো পরীক্ষা করি। সেখানে আমরা এ ধরনের কোনো উপাদান পাইনি। পেলে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এমন পরিস্থিতিতে আজ দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব নিরাপদ খাদ্য দিবস। যদিও সরকারি কোনো কর্মসূচি নেই। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনলাইনে সেমিনার করছে।
বুয়েট ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলটি ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, কলাবাগান, কেরানীগঞ্জ, রামপুরা, সিদ্ধেশ্বরী, পুরানা পল্টন, ধানমন্ডি এলাকা এবং নারায়ণগঞ্জ, ঝিনাইদহ ও ময়মনসিংহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। পরে সেগুলো বুয়েটের ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। গত ২৪ মে ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন নামের একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।
জানতে চাইলে গবেষক দলের সদস্য ও বুয়েটের শিক্ষক আবু বিন ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাউরুটি সব বয়সী মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়। এই খাবারটি নিরাপদ হওয়া জরুরি। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে এই খাবারটির মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। আমাদের দেশে পাউরুটিতে ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান পটাশিয়াম ব্রোমেট পাওয়া যাওয়ার কারণে খাবারটি নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল।’
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, পাউরুটি ফোলানের জন্য বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে একধরনের ছত্রাক ব্যবহৃত হয়। আটায় ওই ছত্রাক দেওয়ার পর ফোলানোর জন্য দীর্ঘ সময় রেখে দিতে হয়। আবার এর দামও তুলনামূলক বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারতসহ অনেক দেশে রুটি ফোলানোর উপাদান হিসেবে খাবার সোডা ব্যবহৃত হতে থাকে। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে অনেক দেশে আটার খামিরকে দীর্ঘ সময় রেখে দেওয়ার জন্য বেকারিমালিকেরা পটাশিয়াম ব্রোমেট ব্যবহার শুরু করেন। এটি দামেও সস্তা। আর পাউরুটিকে আকর্ষণীয়ভাবে ফোলানো, নানা আকৃতি ও রং দেওয়ার ক্ষেত্রে ওই বিষাক্ত উপাদানটি বেশ কার্যকর।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্যপ্রযুক্তি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগের অধ্যাপক মো. আবদুল আলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পাউরুটিসহ বেশির ভাগ বেকারি পণ্যে পটাশিয়াম ব্রোমেট ও ট্রান্সফ্যাটের ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছি। এ ধরনের ক্ষতিকর উপাদান যাতে পাউরুটির মতো জনপ্রিয় পণ্যে ব্যবহার করা না হয়, সে জন্য কঠোর আইন করা হচ্ছে।’
গত দুই যুগে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপানসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পাউরুটিতে এই রাসায়নিকটির ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০১৬ সালে ভারতের পরিবেশবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট থেকে দেশটির ২৫টি বড় কোম্পানির তৈরি পাউরুটি পরীক্ষা করে পটাশিয়াম ব্রোমেট পাওয়া যায়। পরে দেশটির সরকার পাউরুটি প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর ওপরে নজরদারি বাড়ায়। নাইজেরিয়াতেও একই ধরনের গবেষণায় ৮২ শতাংশ পাউরুটিতে ওই উপাদানটি ব্যবহারের প্রমাণ পায় সে দেশের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
গবেষণায় সুপারিশ হিসেবে, বিএসটিআইকে দেশের পাউরুটি তৈরির বেকারিগুলোতে নিয়মিত তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কোথাও ওই ক্ষতিকর উপাদানটি ব্যবহৃত হতে দেখলে সর্বোচ্চ জরিমানার মতো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। আর বেকারির মালিকদের ওই রাসায়নিকটির বদলে ভিটামিন সি পাউডার, ডিম, সসসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নিজামুল হক ভূইয়া প্রথম আলোকে বলেন, পাউরুটিতে এ ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা গুরুতর অপরাধ। বিএসটিআইয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও বেকারিমালিকদের অতি লোভের কারণে এসব হচ্ছে। সরকারের উচিত এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ কঠোর হওয়া।