পাঁচজনের চারজনই অবসরে টিভি দেখে
দেশের তরুণদের ভাবনা জানতে প্রথম আলোর উদ্যোগে ওআরজি-কোয়েস্ট গত মার্চে সারা দেশে জরিপ করেছে। এতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি জঙ্গিবাদ, পারিবারিক মূল্যবোধ, অবসরে কী করে, সে বিষয়েও তরুণদের মতামত জানতে চাওয়া হয়
তরুণদের সবচেয়ে পছন্দের অবসরে টেলিভিশন দেখা। ৮০ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণই পছন্দের অবসর কাটানোর মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের কথা বলেছে। অর্থাৎ প্রতি ৫ জনের ৪ জনই টেলিভিশন দেখে সবচেয়ে বেশি।
তার মানে এই নয় যে তরুণেরা সারা দিন টেলিভিশন দেখেই সময় কাটিয়ে দেয়। তাদের অবসর কাটানোর দ্বিতীয় পছন্দ হচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া। তবে এই দুই পছন্দের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান, ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ টেলিভিশনের তুলনায় আড্ডার জনপ্রিয়তা বেশ কম।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, তরুণদের পছন্দের তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে আড্ডা ও গল্পগুজব। ৪৩ শতাংশ তরুণ অবসরে এভাবে সময় কাটায়। এরপরই রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটানো ও ঘুমানো। এমন তরুণের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, প্রায় ৪১ শতাংশ করে। এ ছাড়া ৩১ শতাংশ তরুণ সংবাদপত্র, ৩০ শতাংশ বই পড়ে, ২৪ শতাংশ খেলাধুলা করে এবং টেলিভিশনে খেলা দেখে ২৪ শতাংশ তরুণ অবসর কাটায়। এ ছাড়া ২১ শতাংশ তরুণ ইন্টারনেটে সময় কাটায়।
অপরাধ ও সহিংসতা প্রতিরোধের পাশাপাশি তরুণদের সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অবসরকালীন কর্মকাণ্ডকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তরুণদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, অবসর সময়ে তারা কী করে? আর তাতেই এই উত্তর পাওয়া গেল।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে, তরুণেরা টেলিভিশনে কী বেশি দেখে। দেখা যাচ্ছে তরুণদের বড় অংশই টেলিভিশনে সবচেয়ে বেশি দেখে নিউজ বা সংবাদ। এই হার অনেক বেশি, ৮৭ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে নাটকও দেখে অনেক তরুণ। ৭০ দশমিক ৫ শতাংশ নাটকের কথা বলেছে। টেলিভিশনে সিনেমা দেখে অবসর কাটানোর কথা বলেছে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ, গান শোনে বা দেখে ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং খেলা দেখে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। তরুণদের কাছে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মধ্যে জনপ্রিয়তার দিক থেকে সবচেয়ে নিচে ‘টক শো’, মাত্র ৬ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ টক শো দেখার কথা বলেছে। এখানে বলে রাখা ভালো, অবসর কাটানো বা টেলিভিশনে বেশি দেখার ক্ষেত্রে তরুণেরা মাত্র একটি করে উত্তর দেয়নি, একাধিক উত্তর দিয়েছে। এ কারণে সব উত্তরদাতার হার ১০০ শতাংশের মধ্য সীমাবদ্ধ রাখা যাচ্ছে না।
বিশ্বজুড়েই তরুণদের অবসর নিয়ে নানা ধরনের জরিপ হয়ে থাকে। প্রায় সব জরিপেই অবসরে টেলিভিশন দেখাটাই থাকে সবার ওপরে। আবার অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখার নেতিবাচক প্রবণতা নিয়ে হয় অসংখ্য সমীক্ষা। সেই ১৯৬১ সালেই টেলিভিশন দেখার প্রভাব নিয়ে ইউনেসকো ব্যাপকভিত্তিক একটি সমীক্ষা করেছিল। তাতে শিশু ও তরুণদের ওপর টেলিভিশন দেখার প্রভাব নিয়ে বেশ সতর্ক বার্তাই দেওয়া হয়েছিল।
তবে বছরের পর বছর ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকার পর এখন অবশ্য টেলিভিশনের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী চলে এসেছে। আর সেটি হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সারা বিশ্বেই এখন এই প্রবণতা। আর এ নিয়ে এখন নানা ধরনের জরিপ ও গবেষণাও হচ্ছে।
প্রথম আলোর জরিপেও দেখা যাচ্ছে, টেলিভিশন দেখা বেশি পছন্দের হলেও তরুণেরা ইন্টারনেটে গল্প বা ‘চ্যাট’ করতেও সময় দিচ্ছে অনেক বেশি। যেমন গড়ে প্রতিদিন টেলিভিশন দেখে গড়ে প্রায় ৮৫ মিনিট, আর ইন্টারনেটে চ্যাট করে ৮০ মিনিট। এমন তরুণও হয়তো কম না, যারা দুটোই একসঙ্গে করে।
জরিপ অনুযায়ী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ জন দিনে আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা এবং ১০০ জনের মধ্যে ১১ জন দুই ঘণ্টার বেশি সময় টিভি দেখে। সেই হিসাবেই তারা গড়ে প্রায় ৮৫ মিনিট টিভি দেখে। এই অভ্যাস ছাত্র-অছাত্র, বিবাহিত-অবিবাহিত থেকে শুরু করে শিক্ষার সব স্তরের তরুণ-তরুণীর মধ্যেই দেখা যায়। ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থাকুক বা না থাকুক, সব ধরনের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি কিংবা শ্রেণি-পেশার মানুষ অবসরে সাধারণত টিভি দেখেই বেশি সময় কাটায়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম তরুণদের টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় কাটানো নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে একজন তরুণের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, যৌন ও আধ্যাত্মিক বিকাশের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে টিভি দেখা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় দেওয়ার ফলে তরুণেরা খেলাধুলা বা শারীরিক পরিশ্রম কম করছে। এতে তাদের শারীরিক বিকাশ ঠিকভাবে হয় না, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। বাস্তব জগৎ ও ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ার যে পার্থক্য, এটাও অনেক সময় তরুণেরা বুঝতে পারে না। এর ফলে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, সৃজনশীলতাও তাদের কমে যায়।
জরিপ বিশ্লেষণেও দেখা যাচ্ছে, সংবাদপত্র ও বই পড়ে এবং খেলাধুলার মতো উপকারী বা স্বাস্থ্যকর অন্যান্য উপায়ে অবসর কাটানোর প্রবণতা এখনকার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে গুরুত্ব হারিয়েছে। আর এসব জায়গা দখল করেছে টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
টেলিভিশনকে সারা বিশ্ব বিকল্প একটি নামে ডাকে, আর তা হলো ‘ইডিয়ট বক্স বা বোকা বাক্স’। মানুষের চিন্তা ও কল্পনাশক্তিকে নষ্ট করে দেয় বলে এই নামে ডাকা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত লেখক, কৌতুক অভিনেতা এবং চলচ্চিত্র তারকা গ্রুচো মার্কস টেলিভিশন নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি টেলিভিশনকে শিক্ষিত হওয়ার খুব বড় উপায় বলে মনে করি। কেননা, প্রতিটি সময় কেউ একজন এসে টেলিভিশন চালু করে আর আমি অন্য রুমে গিয়ে একটি বই নিয়ে বসি।’
জরিপে অংশ নেওয়া তরুণেরা হয়তো বিষয়টা খানিকটা মানছে। অবশ্য বই পড়া নয়, টেলিভিশনে তারা সংবাদ বেশি দেখে বলেই জরিপে বলেছে। আবার ৮০ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতার কাছে দিনের খবর ও নানা তথ্য জানার প্রাথমিক উৎসই হলো টেলিভিশন। আর অর্ধেক (৫০.৪%) উত্তরদাতা জানিয়েছে, তাদের দৈনন্দিনের তথ্য এবং খবর পাওয়ার উৎস হচ্ছে বন্ধুরা। উৎস হিসেবে এরপরের অবস্থানে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও টুইটার (৪০.৩%)। দৈনিক সংবাদপত্র রয়েছে চতুর্থ অবস্থানে। উত্তরদাতাদের এক-চতুর্থাংশ (২৫.৭%) জানিয়েছে, তথ্য এবং খবরের উৎস হিসেবে তারা সংবাদপত্রের ওপর নির্ভর করে। এ ছাড়া গড়ে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জনের তথ্যপ্রাপ্তির উৎস হচ্ছেন স্বামী বা স্ত্রী।
তথ্য জানার ক্ষেত্রে টিভি দেখা কিংবা সংবাদপত্র পড়া—দুটোতেই তরুণেরা প্রায় সমান সময় ব্যয় করে। তরুণদের ৪৮ শতাংশ টিভিতে এবং ৪৯ দশমিক ২ শতাংশ সংবাদপত্রে দিনে আধা ঘণ্টার মতো সময় দেয়। তথ্য জানার জন্য এটাই সর্বোচ্চ সময় ব্যয়।
টিভির তরুণ দর্শকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো বেসরকারি চাকরিজীবীরা (৯৫.২%)। আর কম দক্ষ শ্রমিক (৭১.১) ও গৃহবধূ (৭১.৪)। শহরে টিভিই সবচেয়ে জনপ্রিয় বিনোদনমাধ্যম। সেখানে ১০০ জন তরুণের মধ্যে প্রায় ৯০ জনই অবসরে টিভি দেখে। গ্রামে এই হার ৭৭ শতাংশ। বিভাগ অনুযায়ী হিসাব করলে সিলেটের তরুণ-তরুণীরা সবচেয়ে কম (৫৮.২%) টিভি দেখে।