পাঁচ সৈনিকের চাক্ষুষ বর্ণনা

মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর
মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর

ফেব্রুয়ারি ২০১৪-এর শেষ দিকে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এ আমার চার খণ্ডের একটি রচনা প্রকাশিত হয়। ফেব্রুয়ারির ২২ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত পর পর চার দিন সেটি এ দুই পত্রিকায় যথাক্রমে বাংলা অনুবাদ ও মূল ইংরেজিতে বের হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় ১ জুন ১৯৮১ রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, রচনাটি ছিল সে হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখা।
রচনাটি প্রকাশের ঠিক আগে আগে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের হাতে কিছু নথিপত্র এসে পৌঁছায়। এসব নথি মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছু নতুন ও সমস্যাপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দেয়।

মঞ্জুরের নথি

নথিপত্রগুলোর সত্যাসত্য নির্ণয়ে আমার বন্ধু ও আমাদের বেশ কিছু সময়ের প্রয়োজন হয়। নথিগুলোর বিষয়বস্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে হয়। পাশাপাশি, যে পরিস্থিতিতে এসব নথি আমাদের হাতে আসে, তা-ও আমাদের বুঝতে হয়। এসব নথির সবটাই মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড-সম্পর্কিত। কিন্তু এগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে সে হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর পরে। আর আমাদের হাতে এসেছে ২০১৪ সালে, মঞ্জুরের খুনের ৩৩ বছর পর। এসব নথিতে ১ জুন ১৯৮১ রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে মঞ্জুরের জীবনের শেষ মুহূর্তের কিছু ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। নথিগুলোর ভাষ্যমতেও, মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে হত্যা করা হয়েছিল। এ বিবরণের সঙ্গে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত বিবরণের মিল আছে, তবে কিছু পার্থক্যও আছে। 
যে নথি আমাদের হাতে এসেছে, সেগুলোর মধ্যে আটজন সাধারণ সৈনিকেরও সাক্ষ্য আছে। তার মধ্য থেকে আমরা ওই পাঁচজন সৈনিকের সাক্ষ্যের ওপর গুরুত্ব বেশি দিয়েছি, যাঁরা মঞ্জুর হত্যার চাক্ষুষ বর্ণনা দিয়েছেন। এ সাক্ষ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এ পাঁচ সৈনিক যৌথভাবে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে একদল ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন। উপরন্তু তাঁরা এ অভিযোগও করেছেন যে ঊর্ধ্বতন এই সেনা কর্মকর্তারা একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব’-এর অংশ হিসেবে পরিচিত ‘ওপরের নির্দেশ’ অনুসরণ করছিলেন। এই ‘ওপরের নির্দেশ’-দাতাদের মধ্যে একদল জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, নায়েক ও সুবেদাররা বাংলাদেশ পুলিশের সিআইডির কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তাঁদের নাম বলেছেন।

এই সৈনিকদের ভাষ্যমতে, এই ‘গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব’ দুটো অংশে বিভক্ত। সামরিক ইউনিটের ওপর নির্দেশ ছিল, বেসামরিক নিরাপত্তা-বলয় থেকে মঞ্জুরকে বের করে আনা। ১ জুন ১৯৮১ মঞ্জুর সপরিবারে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁকে রাখা হয় চট্টগ্রাম শহরের বাইরে, হাটহাজারী থানায়। মঞ্জুর পুলিশকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য তাঁকে যেন সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া না হয়। সে সময় পুলিশের আইজিপি এ বি এম জি কিবরিয়ার নির্দেশে হাটহাজারী থানার পুলিশ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ ছাড়া তাঁকে সেনা হেফাজতে পাঠাতে অস্বীকৃতি জানায়।
পূর্ববর্তী রচনার তৃতীয় পর্বে আমরা দেখেছি (‘মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর (বীর উত্তম) হত্যাকাণ্ড’, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪) এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন ও আইজিপি এ বি এম জি কিবরিয়া উভয়েই ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক উত্তপ্ত বৈঠকে রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে অনুরোধ করেন, মঞ্জুরকে যেন সেনা হেফাজতে তুলে দেওয়া না হয়। এই দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পৃথক জবানবন্দি থেকে দেখা যায়, তাঁরা উভয়েই আশঙ্কা করছিলেন যে মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে দেওয়া হলে তাঁর জীবন হুমকির মুখে পড়বে। ওই বৈঠকের সময় চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট হাটহাজারী থেকে মঞ্জুরকে তাদের হেফাজতে নেওয়ার জন্য পথে বেরিয়ে এসেছে।
বঙ্গভবনে বৈঠক চলাকালে সেনাবাহিনীর ইউনিটটি হাটহাজারী থানায় একতরফাভাবে প্রবেশ করে এবং মঞ্জুরকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য দাবি জানায়। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে এ সময় উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। পুলিশ সেনাবাহিনীর উগ্রতাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছিল। অন্যদিকে নিরাপত্তার স্বার্থে মঞ্জুরকে কেন বেসামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনে রাখা উচিত, তা নিয়ে পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা আইজিপি কিবরিয়া তখন সেনাপ্রধান জেনারেল এইচ এম এরশাদের সঙ্গে তর্ক করছিলেন।
মঞ্জুরকে যাঁরা হাটহাজারী থানা থেকে তুলে আনতে গিয়েছিলেন, এই পাঁচ সৈনিক ছিলেন সেই সেনা ইউনিটের সদস্য। তাঁদের সাক্ষ্য অনুযায়ী, এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন ও আইজিপি কিবরিয়ার এ আশঙ্কা মোটেও অমূলক ছিল না।
এই সৈনিকেরা ১৯৯৫ সালে পুলিশের সিআইডি বিভাগের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, সেনানিবাস থেকে হাটহাজারী থানার উদ্দেশে বের হওয়ার সময় ঊর্ধ্বতন এক সামরিক কর্মকর্তা তাঁদের বলেন, মঞ্জুর তাঁদের হেফাজতে আসামাত্র কোনো ‘সুবিধামতো জায়গা’য় তাঁকে ‘শেষ’ করতে হবে। সংক্ষেপে, এই সৈনিকেরা হাটহাজারীর দিকে যাত্রা শুরু করার সময় তাঁদের বলা হয়, এই ‘গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব’-এর উদ্দেশ্য: জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করা।
কমান্ডিং অফিসার মেজর এমদাদ সৈন্যদের বলেছিলেন, এই নির্দেশ সেনাবাহিনীর ‘উপর’ থেকে এসেছে। তাঁদের ভাষ্যমতে, তাঁরা সেনানিবাস থেকে হাটহাজারীর দিকে রওনা হওয়ার আগেই তাঁদের লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন।
এই বিশেষ ইউনিট যখন রওনা দেয়, তখন বিচারপতি সাত্তারের দপ্তরে সদরউদ্দীন ও কিবরিয়ার সঙ্গে এরশাদের তীব্র বিতর্ক চলছে। মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে নেওয়ার জন্য এরশাদ ক্রমাগত চাপ দিচ্ছিলেন। তাঁরা উভয়েই এর বিরোধিতা করেন।
চট্টগ্রামে বেসামরিক ও পুলিশ কর্তারা সে সময় অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন, ঢাকা থেকে কেন কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ আসছে না। ঢাকায় যে তাঁদের কর্মকর্তারা মঞ্জুরের জীবনরক্ষার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করছেন, সে কথা তাঁরা জানতেন না। এক সেনা সূত্রমতে, মঞ্জুর তাঁর এক সহকর্মীকে বলেছিলেন, এরশাদ তাঁকে ‘মেরে ফেলা’র পরিকল্পনা করেছে। আর এ কারণেই তাঁকে যেন পুলিশের হাত থেকে সেনা হেফাজতে পাঠানো না হয়।
বেসামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকায় তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে এক বিকল্প প্রস্তাব দিল। তাঁদের প্রস্তাব ছিল, মঞ্জুর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিমান বাংলাদেশের একটি বিমানে ঢাকায় নেওয়া হোক। বেসামরিক পুলিশ মঞ্জুরের নিরাপত্তা বিধান করবে, আর সেনাবাহিনী নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকবে।
মঞ্জুরের নিজের জীবনের হুমকি থেকে তাঁকে রক্ষা করা আর কখনোই সম্ভব হয়নি। সেনাবাহিনীর ভেতরে মঞ্জুরের শত্রুরা কোনোভাবেই চায়নি যে তিনি জীবিত থাকুন। তবু এই আশাটুকু ছিল যে সেই দ্বিধান্বিত ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে তিনি তাঁর ভাষ্য উপস্থাপন করবেন। ১ জুন ১৯৮১-তে এ রকম এক সন্ধিক্ষণে সবকিছু নির্ভর করছিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারের সিদ্ধান্তের ওপর।
কিন্তু এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন ও আইজিপি কিবরিয়া মঞ্জুরের নিরাপত্তা নিয়ে যে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, সাত্তার তাতে কর্ণপাত না করে কথা রাখেন জেনারেল এরশাদের। এভাবে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত—যেভাবেই হোক না কেন, সাত্তার মঞ্জুরের বিধিলিপি নির্ধারণ করে দেন।
এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন তাঁর স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, তিনি সাত্তারকে অনুরোধ করে বলেছিলেন, ‘স্যার, দয়া করে নিশ্চিত করুন যাতে মঞ্জুরের কিছু না হয় আর তিনি ন্যায্য বিচার পান। মঞ্জুরের কিছু হলে জাতির কাছে আপনাকে জবাব দিতে হবে।’ সাত্তার এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীনকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছিলেন, মঞ্জুরের বিচার করা হবে। সাত্তারের এমন সরল, কিংবা হয়তো একেবারেই অসরল নিশ্চয়তা সত্ত্বেও সেই রাতে মঞ্জুর সেনা হেফাজতে খুন হন। সদরউদ্দীন ও কিবরিয়া এ আশঙ্কাটিই করেছিলেন। আর ঘটলও ঠিক তা-ই।
জেনারেল মঞ্জুর কখনোই আদালতে দাঁড়িয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগটি পেতেন না।
কিংবা জেনারেল এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দায়ের করার চেষ্টা করছিলেন, তা থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও তাঁর মিলত না। সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী ও জেনারেল মীর শওকত আলীর সঙ্গে ১৯৮১ সালের ৩০ মে থেকে ১ জুনের মধ্যে মঞ্জুরের বার কয়েক ফোনালাপ হয়। সেসব ফোনালাপেও তিনি একই আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছিলেন।
আমাদের হাতে যেসব নথি এসেছে, সে অনুযায়ী এই সৈনিকেরা চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ভেতরে চোখের সামনে মঞ্জুরকে হত্যার শিকার হতে দেখেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে যে সৈনিকটি মঞ্জুরকে গুলি করেন, সাক্ষ্য অনুযায়ী তাঁকেও তাঁরা চিহ্নিত করেছেন।
চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার আলী মোহাম্মদ ইকবালের সাক্ষ্যও এ নথিগুলোর মধ্যে আছে। সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তারা ১৯৯৫ সালে যেসব সাক্ষ্যের অডিও ধারণ করেছিলেন এবং পরে সেগুলোর লিখিত রূপ তৈরি করেছিলেন, সেখান থেকে এই সাক্ষ্যগুলো নেওয়া হয়েছে।

২.

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আশফাক আমিন (আমিনুল হকের বড় ছেলে) ও আমিনুল হক। ১৯৯১ সালে তোলা ছবি।  ছবিটি আশফাক আমিনের সৌজন্যে পাওয়া
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আশফাক আমিন (আমিনুল হকের বড় ছেলে) ও আমিনুল হক। ১৯৯১ সালে তোলা ছবি। ছবিটি আশফাক আমিনের সৌজন্যে পাওয়া

আমিনুল হকের ভূমিকা
অ্যাটর্নি জেনারেল ও প্রধান কৌঁসুলি
মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর পর ঠিক কোন পটভূমিতে সিআইডি এ তদন্ত শুরু করে, তা বোঝা দরকার। কেন হঠাৎ প্রায় দেড় দশক পরে সিআইডিকে তদন্তে সম্পৃক্ত করা হলো? নিশ্চয়ই কোনো বিশেষ পরিস্থিতি অতীতে তাঁদের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বছর খানেকের মুহুর্মুহু গণ-আন্দোলনের মুখে ডিসেম্বর ১৯৯০ জেনারেল এরশাদের দশকব্যাপী স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এরশাদকে গ্রেপ্তার করে এবং একটি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করে।
এ সময় সাহাবুদ্দীন আমিনুল হক নামে একজন শ্রদ্ধাভাজন আইনজীবীকে অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ দেন। ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিএনপি নেতৃত্বাধীন একটি জোট সরকার ক্ষমতায় আসে। আমিনুল হক আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হলেও খালেদা জিয়া তাঁকে সে পদে বহাল রাখেন।
আমিনুল হক ১৯৮১ সালের চট্টগ্রামের ঘটনাপ্রবাহের ওপর যে তদন্ত পরিচালনা করছিলেন, সে ব্যাপারে খালেদা জিয়া বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পরের মাসে খালেদা জিয়া তাঁর স্বামীর হত্যাকাণ্ডের জন্য এরশাদকে প্রকাশ্যে দায়ী করেছিলেন। সেটি ছিল একটি ব্যতিক্রমী অভিযোগ। কিন্তু আমিনুলের বিশ্বাস ছিল যে এ অভিযোগের কিছু বাস্তবতা আছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমিনুল হক মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর হত্যার তদন্ত শুরু করেন। সেটি করতে গিয়ে তাঁকে আবশ্যিকভাবে জেনারেল জিয়া হত্যাকাণ্ডের তদন্তও শুরু করতে হয়। আমিনুল হকের সহকর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৯৩-৯৪ সালের মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের হাতে অজস্র নথিপত্র জড়ো হয়। তারাও সামনে এগোনোর এবং আরও গভীরতর তদন্ত শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
বিগত দশকে এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকালে জিয়া ও মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে এরশাদের সম্পৃক্ততা বিষয়ে কারও পক্ষে তদন্ত করতে যাওয়া ছিল নিজের ও তার পরিবারের সদস্যদের ঝুঁকির মুখে ফেলা।
যেকোনো বিচারেই আমিনুল হক ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। পেশাদারি ও সততার জন্য তিনি সব মহলে প্রশংসিত ছিলেন। তা ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুতর পর্যায়গুলোতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন সার্জেন্ট জহুরুল হকের বড় ভাই, ১৯৬৯ সালে আটক থাকা অবস্থায় যাকে হত্যা করা হয়। সার্জেন্ট জহুরুল হক ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি। রাষ্ট্রের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তাঁর মৃত্যু পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক আন্দোলনের জন্ম দেয়। আমিনুল হক মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর শফিউল্লাহ্র নেতৃত্বাধীন এস ফোর্সে একজন যোদ্ধা হিসেবে ভূমিকা রাখেন।
১৯৮১ সালে যে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে নির্যাতন ও সংক্ষিপ্ত বিচারে ‘অতি দ্রুত’ কোর্ট মার্শাল করে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, সেই বিচারে তিনি এই মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করার চেষ্টা করেন। এই মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তাঁরা মঞ্জুরের সঙ্গে চক্রান্ত করে জিয়াকে খুন করেছেন, তবে সে অভিযোগ কখনো প্রমাণ করা যায়নি।
এই ১৩ অফিসারের বিচারে প্রধান ‘সাক্ষ্য’ ছিল তাঁদের কাছ থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করা স্বীকারোক্তি। আদালতে আনার পর তাঁরা সবাই স্বীকারোক্তিগুলো অস্বীকার করেছেন এবং এ অভিযোগ করেছেন যে তাঁদের নির্যাতন করা হয়েছে। কেউ কেউ গায়ের জামা খুলে শরীরের বিভিন্ন স্থানের জখম দেখিয়েছেন। এই সামরিক কর্মকর্তা ও বেসামরিক আইনজীবীরা প্রকাশ্যেই বলেছেন, তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থনে যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমিনুল হক ছিলেন এই বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের একজন।
এরশাদের পতনের পর তন্দ্রাচ্ছন্ন আইনি প্রক্রিয়া আবারও চালু হয়। জেনারেল মঞ্জুরের বড় ভাই আবুল মনসুর আহমেদ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ এরশাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর পরপরই সিআইডি সম্ভাব্য সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করে। তাঁদের মধ্যে এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন ও আইজিপি এ বি এম জি কিবরিয়াও আছেন। তাঁদের সাক্ষ্য আমরা অনুপুঙ্খভাবে তৃতীয় ও চতুর্থ পর্বে পর্যালোচনা করেছি। (দেখুন: প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার, ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)
তাঁর মতো একজন নিবেদিতপ্রাণ অ্যাটর্নি জেনারেলের তত্ত্বাবধানে এটিই প্রথমবারের মতো জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বিশেষ অগ্রগতি হয়। ১৯৯৫ সালের জুন মাসে পুলিশের সিআইডির সহকারী সুপার আবদুল কাহার আকন্দ জেনারেল এরশাদ ও চারজন সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরে এটি ‘মঞ্জুর হত্যা মামলা’ নামে পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করে। যেসব সাক্ষ্য আমাদের হাতে এসেছে, সেগুলোর তারিখ শুরু হয়েছে এর পর থেকে। (চলবে)

[email protected]
লরেন্স লিফশুলৎজ ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ (হংকং)-এর দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি দ্য গার্ডিয়ান, লে মঁদ দিপ্লোমাতিক, দ্য নেশন (নিউইয়র্ক) ও বিবিসির পক্ষে লিখেছেন। তিনি বেশ কিছু বই রচনা ও সম্পাদনা করেছেন; তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ: দি আনফিনিশড রেভল্যুশন, হিরোশিমা’জ শ্যাডো ও হোয়াই বসনিয়া?