পদ্মা সেতুতে প্রথম আট ঘণ্টায় ধারণার চেয়ে বেশি গাড়ির চাপ
পূর্বাভাস ছিল, পদ্মা সেতুতে দিনে গড়ে প্রায় ২৪ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। প্রথম দিনই এই পূর্বাভাসের চেয়েও বেশি যানবাহন চলাচলের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রথম দিন আজ রোববার সকাল ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত সেতু দিয়ে ১৫ হাজার ২০০ যানবাহন চলাচল করেছে। আগামীকাল সোমবার সকাল ছয়টায় পুরো এক দিনের হিসাব পাওয়া যাবে।
এই হিসাব বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বাসেক)। গতকাল শনিবার পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি টোল দিয়ে সেতু পার হন। তবে সাধারণ যানবাহনের জন্য আজ সকাল ছয়টা থেকে সেতু উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
বাসেক সূত্র জানায়, টোল আদায় কার্যক্রম তিন শিফটে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম শিফট বেলা ২টা, দ্বিতীয় শিফট রাত ১০টায় এবং সর্বশেষ শিফট সকাল ৬টায় শেষ হবে। আজ প্রথম আট ঘণ্টায় মাওয়া প্রান্ত দিয়ে যানবাহন পার হয়েছে ৮ হাজার ৪৩৮টি।
অন্যদিকে জাজিরা হয়ে ঢাকার পথে যানবাহন এসেছে ৬ হাজার ৭৬২টি। সব মিলিয়ে দুই প্রান্ত দিয়ে যানবাহন আসা-যাওয়া করেছে ১৫ হাজার ২০০টি। এই যানবাহন থেকে টোল আদায় হয়েছে ৮২ লাখ ১৯ হাজার ৫০ টাকা। এর মধ্যে মাওয়া প্রান্তে টোল উঠেছে ৪৬ লাখ ৮৯ হাজার ৫৫০ টাকা। আর জাজিরা প্রান্তে টোল আদায় হয়েছে ৩৫ লাখ ২৯ হাজার ৫০০ টাকা।
বাসেকের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম শিফটে পারাপার হওয়া যানবাহনের ৬০ শতাংশই মোটরসাইকেল। ব্যক্তিগত গাড়িও চলেছে। তবে পুরো যানবাহনের চিত্র কাল তৈরি করা হবে।
যানবাহন চলাচলের পূর্বাভাস
২০০৫ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে যানবাহন চলাচল ও সেতু থেকে আয়ের একটা পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। পরে ২০১০ সালে নকশা প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ৩৫ বছরের যানবাহনের সংখ্যা এবং আয়ের একটা ছক তৈরি করে। এর ওপর ভিত্তি করে ২০১৯ সালের আগস্টে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে সেতু কর্তৃপক্ষ। এতে আয়, ব্যয় ও মুনাফার বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
পূর্বাভাস অনুসারে, চলতি বছর প্রতিদিন পদ্মা সেতু দিয়ে ২৩ হাজার ৯৫৪টি যানবাহন চলাচল করবে। ২০২৯ সালে তা হবে দৈনিক ৩৪ হাজার ৭২৫টি। ২০৫০ সালে এই সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে ৬৬ হাজার ৮২৯টি। বর্তমানে ফেরিতে যে পরিমাণ যানবাহন পারাপার হয়, তার হিসাব করে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন এবং ভবিষ্যতে উন্নয়ন পরিকল্পনা বিবেচনায় নিয়ে যানবাহন বৃদ্ধির হার নির্ধারণ করেছিলেন পরামর্শকেরা।
পূর্বাভাস অনুসারে, যানবাহন চলাচল করলে পদ্মা সেতু থেকে প্রথম বছর আয় হবে ১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এ হিসাবে ৩৫ বছরে এই সেতু থেকে আয় হবে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে সব টাকা সেতুর নির্মাণ ও পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ঘরে যাবে না। প্রথমেই আয় থেকে সরকারকে ভ্যাট দিতে হবে। টোল আদায়কারীর পেছনে খরচ আছে। এরপর যা থাকবে, তা থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়কে পরিশোধ করতে হবে ঋণের কিস্তি। এসব ব্যয়ের পর টাকা থাকলে তা সেতু কর্তৃপক্ষের মুনাফা হিসেবে বিবেচিত হবে।
পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ হলেও এই টাকা সেতু কর্তৃপক্ষকে ঋণ হিসেবে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ১ শতাংশ সুদে ৩৫ বছরে এই টাকা পরিশোধ করতে হবে। এ জন্য তিন মাস পরপর কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। সব মিলিয়ে ১৪০ কিস্তিতে ঋণের টাকা (সুদ ও আসলে) পরিশোধ করা হবে।
যেভাবে খরচ হবে টোলের টাকা
এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা আছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকারের ঋণ মওকুফ ফান্ডের অর্থ ৩০০ কোটি টাকা। এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। ফলে সেতু বিভাগকে আসল হিসেবে ২৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। এর সঙ্গে বাড়তি ১ শতাংশ হারে সুদ গুনতে হবে। অর্থাৎ সুদ-আসলে পরিশোধ করতে হবে ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তিতে টোলের টাকা ব্যয়ের বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সেতুর সাধারণ রক্ষণাবেক্ষণে টোল থেকে আয়ের সাড়ে ৭ শতাংশ ব্যয় হবে। এর মধ্যে টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের খরচও আছে। প্রতি ১০ বছর পরপর বড় ধরনের মেরামত করতে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চালুর দশম বছরে ৫০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। ২০তম বছরে ব্যয় করতে হবে এক হাজার কোটি টাকা। ৩০তম ও ৪০তম বছরে ব্যয় হবে দেড় হাজার কোটি টাকা করে। আদায় করা টোলের ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কাটা যাবে। অবচয় হবে মোট নির্মাণব্যয়ের ২ শতাংশ হারে। সব ব্যয় শেষে যে টাকা থাকবে, তা থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। আর কিস্তি পরিশোধের পর যে টাকা (মুনাফা) থাকবে, তার ওপর ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দেবে সেতু বিভাগ।
প্রতি ১৫ বছর পরপর টোল হার ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। সে হিসাবে ২০৫৩ সাল নাগাদ একটি প্রাইভেট কারের টোল ২ হাজার টাকার বেশি হবে।