পদ্মা সেতুকে অর্থনৈতিক করিডর বানাতে হবে
আজ ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন। এই সেতুর নির্মাণসহ নানা দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাদ্দাম হোসাইন।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণের জন্য প্রাথমিকভাবে চারটি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মাওয়া–জাজিরা অংশে সেতু নির্মাণের জন্য কী কী বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে?
সামছুল হক: পদ্মা সেতুর প্রস্থ একেক জায়গায় একেক রকম। চারটি স্থান নির্ধারণ করা হলেও প্রস্থ কম দেখে মাওয়া–জাজিরা অংশে সেতু নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করা হয়। এতে খরচও সবচেয়ে কম। আবার বেশিসংখ্যক এলাকাকে যুক্ত করার বিষয়টি মাথায় ছিল।
প্রশ্ন :
দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের আলোচনা শোনা যাচ্ছে। দ্বিতীয় সেতুর জন্য উপযুক্ত স্থান কোনটি হতে পারে?
সামছুল হক: পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা-মাওয়া করিডরে যানবাহনের চাপ বাড়বে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় ধরা হয়েছিল, পদ্মা সেতুতে সবচেয়ে বেশি চলবে ভারী যানবাহন। কারণ, ওই সময় প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেলের পরিমাণ এখনকার মতো ছিল না। এখন এগুলো মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ যানবাহনের সংখ্যা পদ্মা সেতুর ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যেতে পারে। ফলে সরকারকে এখন থেকেই দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর বিষয়ে ভবতে হবে। এ ক্ষেত্রে বর্তমান পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে বিকল্প স্থান নিয়ে করা সমীক্ষা কাজে লাগবে। বঙ্গবন্ধু ও পদ্মা সেতু যেসব এলাকা কাভার করবে না, যেসব এলাকা সরাসরি সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন—সেসব এলাকাকে বিবেচনায় নিয়ে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু করতে হবে।
প্রশ্ন :
প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক উপযোগিতা কেমন?
সামছুল হক: পদ্মা সেতু করিডরের কারণে দ্রুত ঢাকায় আসা যাবে। কিন্তু ঢাকা প্রস্তুত নয়। ফলে এই করিডর ‘কাউন্টার প্রোডাক্টিভ’ হতে পারে। এ জন্য ঢাকায় রোড নেটওয়ার্ক ও সার্কুলার রোডগুলোকে তৈরি করতে হবে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়কগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পদ্মা সেতুকে শুধু পরিবহন করিডরের বদলে অর্থনৈতিক করিডর হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। এ জন্য এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে ইপিজেডের আদলে পরিকল্পিত শিল্পায়ন করতে হবে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু ‘এশিয়ান হাইওয়ে টু’–এর সঙ্গে সংযোগ হয়েছে। মোংলা ও পায়রা বন্দরকে প্রস্তুত করতে পারলে অর্থনীতি উন্নতি করবে।
প্রশ্ন :
পদ্মা সেতুর টোল নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। আপনার মত কী?
সামছুল হক: সরকার সরাসরি কত বিনিয়োগ করেছে, কতটি যানবাহন সেতুটি ব্যবহার করবে—সেসব হিসাব করে নিশ্চয় সেতু কর্তৃপক্ষ টোল নির্ধারণ করেছে। তবে ‘কৌশলগতভাবে’ বিষয়টি ঠিক হয়নি। কারণ, পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান হবে। এতে সরকারের বিকল্প আয়ের সুযোগ তৈরি হবে। বিষয়টি বিবেচনা করলে সেতুর টোল আরও সহনীয় করা যেত। শুরুতে টোল কম রেখে পরে প্রয়োজন অনুযায়ী পুনর্বিবেচনা করা যেত। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে পারলে এই চাপ পড়ত না। অবশ্য এর পেছনে কোভিড এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মতো কিছু বাস্তব কারণও ছিল। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় ব্যয় বেড়েছে। বিনিয়োগের টাকা তুলতে টোলে চাপ পড়েছে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: পদ্মা সেতুতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রেলসেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এই সেতু থেকে কেমন সুফল পাওয়া যাবে?
সামছুল হক: বঙ্গবন্ধু সেতুতে প্রথমে রেলপথ ছিলই না। পরে জোড়াতালি দিয়ে রেলপথ করা হয়েছে। তাতে একটি মাত্র ট্র্যাক রাখা হয়েছে। এতে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে ট্রেন চলতে পারে না। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার বলা হয়েছে, একসঙ্গে রেলসেতু হবে। আমার প্রত্যাশা ছিল, এবার অন্তত সেতুতে দুটি ট্র্যাক হবে। কিন্তু পদ্মা সেতুর নিচে একটি ট্র্যাক দেখে আমি হতাশ হয়েছি। কারণ, রেল বিমান সিকুয়েনশিয়ালি চলে। একটিতে গণ্ডগোল হলে প্রতিটি সময়সূচি বিপর্যস্ত হয়। সে জন্যই ১০০ বছর আগে ব্রিটিশদের করা পাকশী ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজে দুটি করে ট্র্যাক রাখা হয়েছিল। অথচ তখন এত চাহিদা ছিল না। সুষম উন্নয়নের জন্য রেলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, বিশেষ করে মালামাল পরিবহনে। যে টাকায় পদ্মা সেতুতে একটি ট্র্যাক করা হচ্ছে, দ্বিতীয় ট্র্যাকে খরচ তার চেয়ে অনেক কম পড়ত।
সামছুল হক, অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়