নড়িয়ার ড্রেজারে ‘রাসেলস ভাইপার’ এল কী করে
নড়িয়াতেও চন্দ্রবোড়া সাপ, ড্রেজারের ইঞ্জিনরুমে হানা
রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ অত্যন্ত বিষধর
সাপের কামড়ে একজন হাসপাতালে
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসায় স্থিতিশীল আছেন
চাঁদ সওদাগরের মিনতি ছিল লখিন্দরের বাসরঘর যেন হয় নিশ্ছিদ্র। বিশ্বকর্মা তাতে সায়ও দিয়েছিলেন। তাল তাল লোহায় গড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই বাসরঘর। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মনসা দেবীর প্ররোচনায় সুতা পরিমাণ ফাঁকা রেখে দিয়েছিলেন ওতে, তাতেই প্রাণ হারান লখিন্দর।
পদ্মার কাঁচিকাটায় ড্রেজারের ইঞ্জিনরুমও কর্মীদের ভাষায় লখিন্দরের বাসরঘরের মতোই নিশ্ছিদ্র। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) এ জায়গায় ঢোকা বা বেরোনো অত সোজা নয়। সোমবার সকালে ওখানে চন্দ্রবোড়া সাপ ঢুকেছে। প্রায় দুই দশক জাহাজে জাহাজে ঘোরা মো. ইউসুফকে কামড়ও বসিয়েছে। এ এমনই এক সাপ, ২০১২-১৩–এর আগে যাকে দেখা যায়নি প্রায় ১০০ বছর।
মঙ্গলবার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মো. ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, রাবারের চপ্পল পায়ে দিয়েছিলেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই বোঝেন, সাপ কামড়ে দিয়েছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
মো. ইউসুফের সহকর্মী আবদুর রহমান বলেন, সোমবার সকালে ড্রেজার ছিল পদ্মা নদীর সংযোগ খাল কাঁচিকাটায়। ড্রেজারটি এর আগে বছরখানেক বরিশালে ছিল। মো. ইউসুফ যখন সাপ সাপ বলে চিৎকার শুরু করেন, তখনই তাঁরা ছুটে যান। ইঞ্জিনরুম থেকে বেরোতে পারছিল না সাপটি। তাই বাধ্য হয়ে মেরে ফেলেছেন। আর মো. ইউসুফের সাপে কাটা জায়গাটা বেঁধে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেছেন। সেখানে জরুরি চিকিৎসার পর তাঁকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষকে সাপে কাটে। মারা যান প্রায় ছয় হাজার মানুষ। ৮০ প্রজাতির সাপের মধ্যে নদী ও সাগরের সব সাপই বিষধর। তবে গোখরোর তিন প্রজাতি ও কেউটের কয়েক প্রজাতিতে প্রাণহানি বেশি। এসব সাপের কামড়ে প্যারালাইসিস হয়; হাত-পা, চোখ, চোয়াল নাড়তে পারেন না; ঢোকও গিলতে পারেন না রোগী। ঠিকমতো চিকিৎসা না হলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব অকেজো হয়ে মারা যান। কেউ কেউ পঙ্গুও হয়ে যান। রাসেলস ভাইপার গোখরো-কেউটের চেয়েও বিষধর। এই সাপের কামড় খাওয়া রোগীরা চিকিৎসাধীন অবস্থাতেও প্রতি তিনজনে একজন মারা গেছেন।
মো. ইউসুফের খবর পাওয়ার পর রাত পৌনে একটা পর্যন্ত অধ্যাপক এম এ ফায়েজ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধির লাইন ডিরেক্টর রোবেদ আমিন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অনিরুদ্ধ ঘোষ ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইসহাক মজুমদার রোগীর চিকিৎসা কোন পথে এগোবে; তা নিয়ে আলোচনা করেন। একে রাসেলস ভাইপারের কামড়, তার ওপর মো. ইউসুফ আবার হৃদ্রোগেও আক্রান্ত হন।
আজ মঙ্গলবার সকালে মো. ইসহাক মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, রোগী ভালো আছেন। তবে এই কৃতিত্ব জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকেরা দিতে চান শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অপেক্ষাকৃত নবীন চিকিৎসকদের। এই উপজেলা এখন পর্যন্ত বিষধর সাপে কাটা আরও তিনজন রোগীর চিকিৎসা দিয়েছেন। তাঁরা সবাই ভালো আছেন।
রোবেদ আমিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের টুপিখোলা অভিনন্দন। রাসেলস ভাইপার ইঞ্জিন এরিয়ায় একজন অল্পবয়স্ক ব্যক্তির ডান পায়ে কামড়ে দিয়েছিল। এক ঘণ্টার মধ্যে নড়িয়ার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা ডা. রাজীব এবং তাঁর আবাসিক চিকিৎসক, ডা. রাজিয়া ও অন্যরা অ্যান্টিভেনোম দেন, তারপর প্রতি পদক্ষেপে নির্দেশনা মেনে চিকিৎসা দিতে থাকেন।’ তিনি আরও বলেন, কয়েক ঘণ্টা পর রোগীর রক্তচাপ কমতে থাকে এবং বুক ধড়ফড় করতে শুরু করে। চিকিৎসকেরা ইসিজি করে রোগীর বুকে চাপ দিতে থাকেন। এরপর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে পাঠিয়ে দেন। তিনি নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে আদর্শ হাসপাতাল বলেছেন। বলেছেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রতি তাঁর আস্থা আছে, আত্মবিশ্বাস থাকলেই সব সম্ভব।
ড্রেজারের ইঞ্জিনরুমের কর্মী মো. ইউসুফকে ঠিক কী অবস্থায় পেয়েছিলেন নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকেরা? জানতে চাইলে সুলতানা রাজিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ইউসুফ চোখের পাতা খুলতে পারছিলেন না, শ্বাস ভারী হয়ে আসছিল। ছটফট করছিলেন। উপসর্গ দেখেই তিনি বুঝে যান, বিষধর কোনো সাপে কেটেছে তাঁকে। পরে জানতে পারেন, ডান পায়ের পাতার কাছে আঘাত। রোগীর লোকজনও সাপটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। তখন তাঁরা বুঝতে পারেন, এটা রাসেলস ভাইপার। সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক বি এম সাইফ এবং অন্য দুই চিকিৎসক আসিফ মেহরাত মজুমদার ও একরামুল হককে খবর দেন তিনি। সবাই মিলে চিকিৎসা শুরু করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এর আগেও তাঁরা সাপে কাটা তিনজন রোগী দেখেছেন। সমস্যাটা হলো, সাপে কাটা রোগীদের নিয়ে লোকজন প্রথমে যান ওঝার কাছে। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা না গেলে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা কমতে থাকে। তা ছাড়া অ্যান্টিভেনোম ইনজেকশনের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। রোগীর স্বজনদের আগে বোঝাতে হয়, এই ইনজেকশন প্রয়োগ করলেও কিছু সমস্যা হতে পারে।
কিন্তু এত সব প্রশ্নের বাইরেও আরও একটা প্রশ্ন নতুন করে উঠেছে। তা হলো, রাসেলস ভাইপার নড়িয়ায় এল কী করে?
নড়িয়ার ড্রেজারে রাসেলস ভাইপার এল কী করে?
বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির প্রধান অধ্যাপক এম এ ফায়েজ প্রথম আলোকে বলেন, রাসেলস ভাইপার শ্রীলঙ্কার কিছু অঞ্চল, ভারতের কিছু অংশ, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়ায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে প্রায় ১০০ বছর এ সাপের অস্তিত্বের কথা জানা যায়নি। ২০১৩ সালে প্রথম রাজশাহী মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকেরা রাসেলস ভাইপারের কামড় খাওয়া রোগী পান। ৫ বছরে ৩০০ রোগী পেয়েছেন তাঁরা। গত কয়েক বছরে কুষ্টিয়াতেও রাসেলস ভাইপারের বিচরণ সম্পর্কে জানা গেছে। কিন্তু শরীয়তপুরের নড়িয়ায় এই সাপ কী করে এল, সে সম্পর্কে তাঁরা এখনো নিশ্চিত নন।
টক্সিকোলজি সোসাইটি এই সাপ কী করে এত দূর এল, জানতে ড্রেজারের অবস্থান কোথায় কোথায় ছিল, চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ভেনোম রিসার্চ সেন্টার গড়ে উঠেছে। উদ্দেশ্য, দেশেই অ্যান্টিভেনোম তৈরি করা। চিকিৎসকেরা জানান, এখন যে অ্যান্টিভেনোম রোগীদের দেওয়া হচ্ছে, তা ভারত থেকে আমদানি করা হয়। এক অঞ্চলের সাপের ধরন-ধারণ, স্বভাব আলাদা। তাদের বিষ থেকে তৈরি অ্যান্টিভেনোম অন্য অঞ্চলে ভালো কাজ করে না। ভেনোম রিসার্চ সেন্টার এখন দেশি সাপের বিষ সংগ্রহ করছে।
এই সেন্টারের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর অনিরুদ্ধ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, বহু পুরোনো নথিপত্রে রাসেলস ভাইপারের কথা আছে। অনেক বছর এই সাপের কোনো খবর ছিল না। তাঁদের ধারণা, রাসেলস ভাইপার গঙ্গা-পদ্মা নদীকে আশ্রয় করে বেঁচে আছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে নতুন করে বাংলাদেশে ঢুকেছে। রাজশাহী, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর পর্যন্ত পদ্মার দুই ধারে তাঁরা রাসেলস ভাইপার পেয়েছেন। নমুনাও সংগ্রহ করেছেন।