নীরব প্রতিশোধ নিন: খালেদা
ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিজ দল-সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট দিয়ে ‘সরকারের অপরাধের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিশোধ’ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
গতকাল রোববার গুলশানে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া এ আহ্বান জানান। তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন এবং ভোটের দিন ও আগে-পরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েনের জন্য আবারও দাবি জানান। তিনি বলেন, নির্বাচনে কারচুপি হলে জনগণের সঙ্গে বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সাতটি কারণ উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, এই নির্বাচনকে তাঁরা সরকার, আওয়ামী লীগ, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য একটি ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে নিয়েছেন। এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কোনো পরিবর্তন হবে না। এমন একটি নির্বাচনেও যদি সন্ত্রাস, ডাকাতি, কারচুপির মাধ্যমে সরকার জনগণের রায় বদলে ফেলে, তাহলে আবারও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে যে এদের অধীনে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবান্তর।
খালেদা জিয়া দাবি করেন, এখন পর্যন্ত ‘টেস্ট কেসে’ সরকার, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শোচনীয়ভাবে ফেল করে চলেছে। আলাদা দুটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা জয়ী হলেই যে নির্বাচন কমিশন পূত-পবিত্র হয়ে যাবে, তা নয়। এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, হবেও না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন যেকোনো সরকারের অধীনে হতে পারে। জাতীয় নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় বিধায় সরকার সে সময় ব্যাপক কারচুপি ও সন্ত্রাসের আশ্রয় নেবে।
৪ এপ্রিল এই কার্যালয় থেকে আদালতে গিয়ে জামিন নিয়ে বাসায় ফেরার পর গতকালই খালেদা জিয়া প্রথম কার্যালয়ে যান। গত ৩ জানুয়ারি রাত থেকে টানা তিন মাস তিনি ওই কার্যালয়ে অবস্থান করেন। ৫ জানুয়ারি সেখান থেকে তিনি টানা অবরোধের ডাক দিয়েছিলেন। ৪ এপ্রিল বাসায় ফেরার পর আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং বিএনপি নির্বাচনমুখী হয়।
বেলা দুইটার দিকে শুরু হয় সংবাদ সম্মেলন। খালেদা জিয়ার প্রায় এক ঘণ্টার বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। তাঁর অভিযোগ, পরাজয় বুঝতে পেরে সরকার বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের প্রচারকাজে বাধা দিচ্ছে ও হামলা চালাচ্ছে। ভোটাররা যাতে ভয় পেয়ে ভোটকেন্দ্রে না যান, সে জন্য তারা সর্বমুখী সন্ত্রাস চালাচ্ছে। পুলিশকে বিরোধী প্রার্থী ও ভোটারদের হয়রানির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পুলিশ ও সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের হুমকি দিচ্ছে।
ভোটের দিন বিকেল থেকে ভোটকেন্দ্রে ‘পাহারা’ বসানোর আহ্বান জানিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ‘গণনা শেষে ফলাফল বুঝে নিয়ে আপনারা কেন্দ্র ত্যাগ করবেন। যাতে আপনাদের দেওয়া রায় ওরা বদলে ফেলতে না পারে।’ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের অনুরোধ জানান তিনি।
আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা অবাধে টাকা ছড়াচ্ছে, এমন অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, ‘মনে রাখবেন, দেশের সম্পদ লুটপাট করে এবং আপনাদের রক্ত শুষে এরা টাকার পাহাড় গড়েছে। কাজেই এরা যে টাকা বিলাচ্ছে, সেটা আপনাদেরই টাকা। ওদের কাছ থেকে এ টাকা নিলেও ভোট বিক্রি করবেন না। টাকা নেবেন, কিন্তু বিবেক অনুযায়ী ভোট দেবেন। কারণ, ভোট বিক্রি আর ইমান বিক্রি একই কথা।’
সেনাবাহিনী মোতায়েনের পরিবর্তিত সিদ্ধান্তকে ‘অর্থহীন ও প্রতারণামূলক’ আখ্যা দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, এতে প্রমাণিত হলো, আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস, ভোট ডাকাতি ও কারসাজির মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে ফেলার এবং ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখানোর যে পরিকল্পনা এঁটেছে, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীকে তারা বাধা বলে মনে করছে। তিনি বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনী এলাকাজুড়ে ভোটের দিন এবং আগে-পরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেনা মোতায়েনের জন্য আবারও দাবি জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ‘মনে রাখবেন, সব দিন সমান যায় না। এ পর্যন্ত যা-ই করেছেন, তিনটি সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হতে দিন। এতে আপনারÿক্ষমতা যাচ্ছে না।’ গণতন্ত্র ও সংলাপের পথে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘আপনি নামতে ভয় পাচ্ছেন। আপনি ভয় পাবেন না। আমরা আপনার মতো প্রতিশোধপ্রবণ নই।...আমরা আপনাকে সহি সালামতে নিরাপদে নামতে সাহায্য করব এবং একই সমতলে দাঁড়িয়ে নির্বাচন করব। মানুষ যাকে খুশি বেছে নেবে। আসুন, সেই পথটা অন্তত খুলে দিই।’
সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, লুটপাট, খুন-গুম, নির্যাতনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া ঢাকা উত্তরে তাবিথ আউয়াল, দক্ষিণে মির্জা আব্বাস এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে মনজুর আলমকে ভোট দিয়ে এসবের জবাব দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ঢাকা ও চট্টগ্রামের মানুষ একটুখানি সুযোগ পেলেই নীরব ভোট বিপ্লব ঘটিয়ে এসব অপতৎপরতা ও অত্যাচারের বদলা নেবে, উপযুক্ত জবাব দেবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া দাবি করেন, বিএনপি জোটের আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী লীগের লোকজনই পেট্রলবোমা মেরেছে। তাই তিনি আওয়ামী লীগকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানান।
সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ভয় না পেয়ে সকাল সকাল ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার এবং অনিয়ম ও কারচুপি দেখলে প্রতিবাদ করার পরামর্শ দেন খালেদা জিয়া। ভোটারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনার ভোট হোক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভোট। আপনার ভোট হোক বাসযোগ্য, পরিচ্ছন্ন, উন্নত, আধুনিক, যানজটমুক্ত, পরিকল্পিত ও নিরাপদ নগর গড়ার পক্ষের ভোট।’
খালেদা জিয়া বলেন, উত্তরা, কারওয়ান বাজার, ফকিরাপুলের কাছে ও বাংলামোটরে তাঁর গাড়িবহরে পর পর চার দিন হামলা হয়েছে। প্রতিটি হামলার ঘটনাই প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের সরাসরি উসকানির ফল এবং সুপরিকল্পিত। কারওয়ান বাজারে হামলার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তখন সবেমাত্র গাড়িতে উঠে বসেছি। আমি যে পাশে বসা ছিলাম, সেই পাশেই গাড়ির জানালার কাচে গুলি লাগে। এতে কাচ ভেদ না করলেও তা ফেটে যায়। আল্লাহর রহমতে অল্পের জন্য আমার জীবন রক্ষা পায়। কতটা মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি করলে বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাচ ফেটে যায়, তা সবাই বোঝে। এটা যে আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত সুপরিকল্পিত হামলা ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’ এ পর্যায়ে নিজের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ করে কেঁদে ওঠেন তিনি। তিনি বলেন, তাঁর একমাত্র জীবিত সন্তান (বড় ছেলে তারেক রহমান) অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন ধরে দূরদেশে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, তাঁদের অবরোধ এখন আর সক্রিয় নয়। জোটের বৈঠকে অবরোধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সরকারের সঙ্গে গোপন কোনো সমঝোতা হয়নি বলেও তিনি জানান। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি এখনো ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ভোটার। যে কারণে তিনি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন না।
সংবাদ সম্মেলনে আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, জমির উদ্দিন সরকারসহ বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
অবশ্য খালেদা জিয়াকে প্রত্যাখ্যান করেই জনগণ নীরব বিপ্লব ঘটাবে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন। গতকাল খালেদা জিয়ার বক্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি এ মন্তব্য করে বলেন, তিনি (খালেদা জিয়া) একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছেন। তিনি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছেন। তাঁর বাহিনী নিয়ে গুলি করছেন। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন। খালেদা জিয়ার অভিযোগ মনগড়া।
একই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সহস্র নাগরিক কমিটির আহ্বায় সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ‘খালেদা জিয়া বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন, আমি তার জবাবে বলব, খালেদা জিয়া সরাকে ধরা জ্ঞান করছেন। তাঁকে সারা জীবন সরার মধ্যেই থাকতে হবে। খালেদা জিয়া হতাশাগ্রস্ত। তিনি জাতীয় নেতা হতে চান, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ের মানুষ হিসেবে নিজেকে তিনি গড়ে তুলতে পারেননি।’