নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে
আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব—গত এক বছরে নির্বাচনের এই সংস্কৃতি বদলে গেছে। ফিরে এসেছে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মারার রীতি।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে অতীতের রেকর্ড ভেঙে খারাপ নজিরও স্থাপন করেছে। দীর্ঘ দুই যুগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য যে ধারা তৈরি হয়েছিল, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে তা ভেঙে গেছে। অর্ধেকেরও বেশি ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। কারণ, ১৫৩টি আসনের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। এরপর উপজেলাসহ অন্যান্য নির্বাচনেও একই ধারা বহাল থেকেছে।
কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের কারও কারও মতে, ইসির যা কিছু অর্জন ছিল, বর্তমান কমিশন তার সবই বিসর্জন দিয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা সরকারের নির্বাচনী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগী সংগঠনের মতো কাজ করছে।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ প্রথম আলোকে বলেন, কমিশন ও জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্বাচন হয়নি। কারণ, একটি প্রধান দল নির্বাচনে আসেনি। তারা নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। এ অবস্থায় সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার কারণে কমিশন নির্বাচন করতে বাধ্য হয়েছে। নির্বাচন না হলে অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় আসত এবং সহিংসতা আরও বেশি হতো। সুতরাং সার্বিকভাবে কমিশন সঠিক কাজ করেছে।
সরকারের পূর্বপরিকল্পনা ও কমিশনের সমর্থন: ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের বিদায়ের পর নিয়োগ পান কাজী রকিব উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশন। রাষ্ট্রপতির অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে কমিশনের সদস্যরা নিয়োগ পাওয়ায় অনেকেই আশ্বস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কমিশন এই আস্থার মূল্য দিতে পারেনি। কমিশনাররা নিজেদের কর্মকাণ্ডে প্রমাণ করেছেন, তাঁরা প্রধানত রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন।
২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারের দশম সংসদ নির্বাচকেন্দ্রিক পরিকল্পনা শুরু হয়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলোপ করা হয়। বিরোধী দল বিএনপি তখন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি পুনর্বহাল না হলে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে জানায়।
এরপর সংসদ নির্বাচনের আগে ইউনিয়ন পরিষদ এবং রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয়েছিল। চার সিটি নির্বাচনেই জিতেছিল বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা। তবে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারও কারও মতে, ইউপি ও সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু করার পেছনে নির্বাচন কমিশনের কোনো ভূমিকা ছিল না। দলীয় সরকারের অধীনেও নির্বাচন সুষ্ঠু হয় এবং বর্তমান কমিশন নিরপেক্ষ—এই তত্ত্ব প্রমাণের জন্য সরকারই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের আগে সরকার দেশবাসীকে এমন ধারণা দিতে চেয়েছিল।
নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলেও নির্বাচন কমিশন সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) নামের একটি দলকে নিবন্ধিত করে। এই দলটি শুরুতে অনানুষ্ঠানিকভাবে দলীয় প্রতীক হিসেবে ‘গমের শিষ’-এর জন্য আবেদন করবে বলে জানিয়েছিল, যা দেখতে বিএনপির প্রতীক ‘ধানের শীষ’-এর মতো। অভিযোগ আছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পরামর্শে কমিশন বিএনএফকে নিবন্ধিত করে। যদিও শেষ পর্যন্ত দলটিকে টেলিভিশন প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়।
তামাশার নির্বাচন: নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৪১টি হলেও নির্বাচনে অংশ নেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার অনুসারী ১২টি দল। বিএনপিসহ বাকি দলগুলো নির্বাচন বর্জন করলেও তাদের নির্বাচনে নিয়ে আসার জন্য কমিশন কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয় ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর। মোট ভোটার সংখ্যা কত, কোন আসনে কত ভোটার, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার সংখ্যা কত? এ-সংক্রান্ত ১ নম্বর পরিপত্র চূড়ান্ত না করেই তফসিল ঘোষণা করা হয়।
তফসিল অনুযায়ী ১৩ ডিসেম্বর প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন থাকলেও কমিশন অবৈধভাবে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রত্যাহারের সুযোগ দেয়। শেষ মুহূর্তে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। এতে জাপার অনেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। একই সময়ে এরশাদের স্ত্রী জাপার সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলের অপর অংশ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে এরশাদসহ অনেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করলেও তা গ্রহণ করা হয়নি। আবার অনেক জায়গায় জাপাকে আসন ছেড়ে দিতে আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এরশাদ দলীয় প্রতীক ‘লাঙ্গল’ কাউকে বরাদ্দ না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে কমিশনকে চিঠি দিলেও তা গ্রহণ হয়নি। অথচ আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমামের একাধিক অবৈধ চিঠিকে আমলে নেয় কমিশন। কে, কোথায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী হবেন, কার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার হবে, সে বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন এইচ টি ইমাম। বিষয়গুলো জানা সত্ত্বেও কমিশন থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এভাবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা শেষে দেখা যায়, ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী, যা সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। এরশাদসহ জাপার বেশ কয়েকজন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন জমা দেওয়ার পরও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, কেউ নির্বাচনী জোট গঠন করলে তা তফসিল ঘোষণার তিন দিনের মধ্যে কমিশনকে জানাতে হয়। আওয়ামী লীগ তাদের জোটের জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও তরিকত ফেডারেশনের প্রার্থীদের ‘নৌকা’ প্রতীক বরাদ্দের জন্য চিঠি দেয় তফসিল ঘোষণার ১৭ দিন পর। বেআইনি এই চিঠিও আমলে নেয় নির্বাচন কমিশন।
এরপর মানুষ হত্যা, বলপ্রয়োগ, ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে ৫ জানুয়ারি ১৪৭টি আসনেভোট গ্রহণ হয়। ভোট শেষে রাত আড়াইটায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন জানালেন, ৯৭ শতাংশ কেন্দ্রে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। অথচ রাতেই জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রতিরোধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে ৩৬ আসনের ৫৩৯ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।
ভোটের আগে ১৪ ডিসেম্বর থেকে কমিশন প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণীর হালফনামা ওয়েবসাইটে প্রকাশ শুরু করে। এতে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই অস্বাভাবিক সম্পদের মালিক হয়েছেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি শুরু হলে ২২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহ্বায়ক মহীউদ্দীন খান আলমগীর কমিশনে গিয়ে হলফনামা প্রকাশ বন্ধ করার অনুরোধ করেন। এর পর থেকে কমিশনের ওয়েবসাইটে হলফনামাগুলো আর পাওয়া যাচ্ছিল না। এ-সংক্রান্ত আদালতের নির্দেশনা সম্পর্কে জানার এক দিন পর পুনরায় হলফনামা প্রকাশ করা হয়।
নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, প্রচারণার ক্ষেত্রে সরকারি প্রচারমাধ্যম ব্যবহারের সুযোগ না থাকলেও ক্ষমতাসীন দল তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশনে তাদের উন্নয়নের ফিরিস্তির প্রচার শুরু করে। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু তারা সেটা না করে সরকারের হয়ে জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করেছে। বলপ্রয়োগের নির্বাচনের সংস্কৃতি তৈরি করে কমিশন ও সরকার এখন জনগণের প্রতিপক্ষ। কমিশন চাইলে বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ এড়িয়ে যেতে পারত। কারণ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাদের সব ধরনের ক্ষমতা দেওয়া আছে। কিন্তু তারা সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেনি।
উপজেলা নির্বাচন: সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেন। ৪৮২টি উপজেলার নির্বাচনে মাঠপর্যায়ে কমিশনের চেয়ে সরকারের প্রশাসনের তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়।
পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনের প্রথম দুই ধাপ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ছিল। এতে চেয়ারম্যান পদে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা ৯৭ এবং আওয়ামী লীগ-সমর্থিতরা ৮১টি উপজেলায় জয়ী হন। এরপর শেষ তিন ধাপের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা বলপ্রয়োগ শুরু করে। কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে প্রকাশ্যে সিল মেরে নিজেদের প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করে সরকারি দল। শেষমেশ ২৪৫টি উপজেলায় আওয়ামী লীগ এবং ১৬৫টিতে বিএনপি-সমর্থিতদের বিজয়ী দেখানো হয়। ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি তেমন ছিল না। কিন্তু কমিশন ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পড়ার কথা বলেছিল।
উপজেলা নির্বাচনে অনিয়ম ও সহিংসতারোধ কমিশন ক্ষমতা প্রয়োগ করেনি। উল্টো আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে, নির্বাচনে মাঠের ক্ষমতা রিটার্নিং কর্মকর্তাদের, নির্বাচন কমিশনের নয়। উপজেলা নির্বাচন চলাকালে সিইসির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। নির্বাচনের মাঝপথে ২ মার্চ এক মাসেরও বেশি সময়ের জন্য দেশের বাইরে চলে যান তিনি।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত এক বছরে দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। কমিশনের ওপর মানুষের আর আস্থা নেই। ১৯৯১ থেকে ধীরে ধীরে সুষ্ঠু নির্বাচনের যে ধারা তৈরি হয়েছিল, তা ফিরে পেতে অনেক সময় লাগবে। বিষয়টি ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।